ভূমিকা : নিরতিশয় মেহেরবান আল্লাহর নামে শুরু করছি। সেদিন সোসাল মিডিয়ার জনকল্যাণে অবগত হয়েছি যে, "২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে আমাদের নজরুল" শিরোনামে একটি ধারাবাহিক লেখার প্রস্তাব এল। নজরুল ইন্সটিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির আলোকে এ আহবানে সাড়া দিয়ে বিষয়ভিত্তিক এক হাজার শব্দের এ রচনাশৈলী শুরু করছি।
নজরুল পরিচিতি: জন্ম : ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ ২৪ মে ১৮৯৯ খৃ: তৎকালীন ভারতবর্ষের আসানসোল মহকুমার বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান পশ্চিম বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
মৃত্যু - ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ (বয়স ৭৭) ততৎকালীন পিজি হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ
জাতীয়তা: (১৮৯৯–১৯৪৭) বৃটিশ ভারতীয়। (১৯৪৭–১৯৭২) ভারতীয়। (১৯৭২–১৯৭৬) বাংলাদেশী।
পিতা, কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। ১৯৭৪ এ ঢাকা আসেন ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি উপাধি পান।
মূল আলোচনা : আমাদের নজরুল , জাতীয় জীবনে নজরুল, বর্ণে, ছন্দে, ও সংগীতে নজরুল। এবার আবিষ্কার হল "২৪-এর গণঅভুৎত্থানে আমাদের নজরুল"। প্রকাশিত এ কথাগুলো একান্তই আপন ও আমাদের ভূবনের প্রাসঙ্গিক, মনের কথার বহিঃপ্রকাশ।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, অত্যাচার , নিপিড়ন ও মজলুম জনতার কন্ঠস্বর খ্যাত, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম । শাসকের শোষণ, ক্ষমতার দম্ভ আর অত্যাচারির বুকে জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসে যুগে যুগে ছন্দ তালে তুলেছেন প্রতিবাদের ঝড়। কুড়িয়েছেন মনি-মুক্তো সমতুল্য অফুরান ভালোবাসা। সীমাহীন পাঠক প্রিয়তার শীর্ষে তার রচিত কাব্যকথন ও রচনা সম্ভার। আকূল পিয়াসে মনে গেঁথেছেন প্রতিরোধের বিধ্বংসী শব্দমালা।
আমি সেই দিন হব শান্ত ,
যবে উৎপিরিতের ক্রন্দন রোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না , অত্যাচারীর খড়গ কৃপান বীরভূমে রণ রনিবে না , বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত -- নজরুল।
২০২৪ সালে জুলাই মাসের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে ছাত্র নাগরিকদের অভূতপূর্ব কোটা সংস্কারের দাবী, আন্দোলন চুড়ান্ত গণ অভুৎত্থানে রুপ নেয়। আন্দোলনের শুরু থেকেই ছাত্র-ছাত্রীরা নজরুলের লেখা গান ও কবিতায় নিজেদের স্লোগান শক্তি খুঁজে পান। মিছিল, সংগ্রাম আর ছাত্র জনতার রাজপথের গণপদচারনা হয়ে ওঠে নজরুলময়।
যেমন: দূর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার , কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট, শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল ইত্যাদি গান ও শীর নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর, ঊর্ধ গগণে বাজে মাদল নিন্ম উতলা ধরণী তল , চলরে চলরে চল....এর মত বিদ্রোহী কবিতা স্লোগানে, মিছিল ও বক্তৃতার অংশ জুড়ে ব্যাপক সহযোগিতা ও সাহস যুগিয়েছিল। ইস্পাত কঠিক শাসক গোষ্ঠীর অজেয় শক্তিকে না বলে, হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ রেখে বীর ছাত্র-যুবকেরা অন্যায়ের সামনে মাথা না নোয়ানোর শপথ নেন। উচ্চ স্বরে ইথারে ইথারে বলে আসছিল, ছাত্র হত্যার বিচার চাই, আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই, রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায় ইত্যাদি।
একদিকে প্রভাত পেরুলেই ক্লাস, পরীক্ষা বর্জন করে ঢাকার রাজপথে নেমে আসতো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীরা অন্যদিকে সাজোঁয়া যান, গরম পানি ও নেমে আসতো পোশাকধারী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। সেনাবাহিনী, বি জি বি, পুলিশ, ব্যাটালিয়ন , সোয়াত ও আনসার বাহিনীর পাশাপাশি মাঠে নামত একঝাঁক ছদ্মবেশী এস বি, এন এস আই, ডিজিএফআই ও ডিবির চৌকশ গোয়েন্দা সদস্যরা। উদ্দেশ্য আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ ও সরকার এর গদি ঠিক রাখা।
মুহুর্মুহু গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড , টি আর সেল , কাঁদানো গ্যাস ও ভারী যুদ্ধাস্ত্রের সামনে ঘাড় উঁচিয়ে বুক চেতিয়ে ছাত্র-জনতা মুক্ত স্লোগানে সেদিন নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল, " এক দফা এক দাবী , স্বৈরাচার কবে যাবি"
দীর্ঘ প্রায় দুই মাস আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধ শেষে ছাত্র-জনতা ছিনিয়ে এনেছিল সুবিশাল জয়, একটি স্বাধীন নি:শ্বাস ও ঘটিয়েছিল অশুভশক্তি ধর স্বৈরাচারী সরকারের ঘৃণ্য পরাজয়।
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র শহীদ আবু সাইদের উপর পুলিশের গুলি পরবর্তী ছাত্র হত্যার সংখ্যা গণনা শুরু হয়ে এ পর্যন্ত মিডিয়ার প্রকাশিত খবরের বরাতে ৮৮৫ জন শহীদের তথ্য পাওয়া যায়। জার্মানির হিটলার, ইটালির মুসোলিনীর পর বাংলাদেশেএকটি স্বৈরশাসক এর নিশ্চিহ্ন পরাজয় দেখল বিশ্ববাসী।
বাংলাদেশের জুলাই গণহত্যা এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক প্রচারিত, শ্রুত ও স্বীকৃত গণহত্যা। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম যেমন, সি এন এন, রয়টার্স , বিবিসি, আলজাজিরা, এন ডি টিভি , আলজাজিরা, ডয়েসেভেলে সহ প্রায় সকল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গুরুত্বের সাথে এ আন্দোলন, গনহত্যা ও সহিংসতার খবর প্রচারিত হয়েছে। বিভিন্ন প্লেকার্ড, হ্যান্ডবিল ও বাণী বন্দনায় প্রচার হয়েছে নজরুলের জ্বালাময়ী বিদ্রোহী গান ও কবিতার অংশবিশেষ আর তা পৌঁছে গেছে বিশ্ব দরবারে।
সকল সংকট, সংশয়ের ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও তার সুধাময়ী গান, কবিতা যে প্রাসঙ্গিক তার প্রমাণ এক বার নয় বারবার প্রমাণিত।
বাংলাদেশের শান্তি, সংহতি, একতা, সম্প্রীতি ও স্বাধীনতার প্রশ্নে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন উদার গণতান্ত্রিক । নজরুল লিখেছেন "এই মায়েরি বুকে হেসে খেলে সুখে, ঘুমাবো এই বুকে স্বপ্নাতুর" নজরুল চেতনায় সমৃদ্ধ শিক্ষার্থীরা বজ্রকণ্ঠে তুলেছিল নজরুলের আওয়াজ, ভুলেছিল বেঁচে থাকার স্বপ্ন, পরাজিত করেছিল অহংকারীর গর্ব।
একটি স্বাতন্ত্র স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় সাম্য, মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে ছাত্র-জনতা ও স্বাধীনতাকামী নাগরিক সমাজ ২০২৪ এ জুলাই আন্দোলনে যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা প্রকট উদাহরণ হয়ে যুগ যুগান্তরে নদীর মত প্রবাহমান থাকবে।
ইতিহাস স্বীকৃত যুগান্তকারী এ আন্দোলন ও অভ্যুত্থান বাঙালি জাতির প্রেরণা হয়ে আগামী দিনের স্বপ্ন বুনবে। বিজয়ী আন্দোলন, বিজয় ও ২য় স্বাধীনতা পরবর্তী আগষ্টের দেয়ালচিত্র, গ্রাফিতী চিত্র শিল্পীর তুলিতে যেভাবে নজরুল জায়গা করে নিয়েছেন তার সৃষ্টি গান ও কবিতায় তা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের অন্য কোন কবির উদাহরণে পাওয়া যায় কিনা ভেবে দেখবেন। এতেই প্রতীয়মান হয়।
" ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান আমাদের নজরুল" কোন পক্ষের নয় শুধু বাংলা পক্ষের অর্থাৎ আমাদের ই রয়ে গেল। নজরুলময় এ বাংলাদেশে সকল সপ্নের সম্ভাবনাকে সফল করতে একতাবদ্ধ হতে চাই।
লেখক : কবি, সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার বার্তা/এমই