মাছে-ভাতে বাঙাালি এই পরিচয়ে জাতি হিসেবে আমাদের স্বকীয়তার প্রতীক। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ,কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, মৎস্য খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার,জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান,রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে আরো সম্পৃক্ত ও সচেতন করার প্রয়াসে মৎস্য অধিদপ্তর কাজ করলেও অনেকক্ষেত্রে নজরদারীর অভাব রয়েছে। আমাদের দেশে শিল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য হলেও ওয়াশিং প্লান্টের বর্জ্য দ্বারা প্রতিনিয়ত ড্রেন,খাল,বিল, নদী দূষণের ফলে মিঠা পানির দেশীয় জাতের সকল মাছ মরে যাচ্ছে এবং বিলুপ্তির পথে। উন্নত বিশ্বের কোনো দেশে যেখানে একটি খালি বোতল যথোপযুক্ত স্থান ছাড়া ফেলা হয় না, সেক্ষেত্রে যত্র তত্র বর্জ্য ফেলে পরিবেশ দূষণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে ।
সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা আমাদের সোনার বাংলাদেশ। এদেশের পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রেখে আসছে আমাদের দেশের পুকুর, খাল, বিল, নদ-নদী। বেকারত্ব দূরীকরণ ও দেশকে স্বাবলম্বী করতে মৎস্য শিল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অথচ ওয়াশিং প্ল্যান্টের বর্জ্য ইটিপি না করে সরাসরি ড্রেনে/ জলাশয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে আমাদের মিঠা পানির দেশীয় পুঁটি, কই, শিং,রুই, কাতল, বোয়াল ও অন্যান্য দেশীয় জাতের মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে অবিরাম। ফলে মিঠাপানির দেশীয় আমিষযুক্ত মাছের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও তা পূরণ হচ্ছে না। সাভার ও ধামরাইয়ে বংশী নদীতে ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত হাজারীবাগের বিশ্রী দুর্গন্ধের ট্যানারী শিল্পের বর্জ্য দ্বারা নদী দূষণ হচ্ছে। ওয়াশিং প্লান্টের বর্জ্য ও শিল্পের বর্জ্য প্রধান দুষণকারী হিসেবে কাজ করলেও প্লাষ্টিকের শক্ত বর্জ্য, বোতল, টায়ার টিউব, পরিত্যক্ত কাঁচামাল, আলকাতরা, জ্বালানী তেল, কাপড় ধোয়ার ময়লা, তারকাটা, পেরেক, কাঠ, পলিথিন, টুকরো কাপড়, খাদ্য ইত্যাদির ময়লা বিভিন্ন জলাশয় ও নদীকে দুষিত করছে। বাংলাদেশে ৫৬ হাজার বর্গমাইলে ১৯ কোটি মানুষের চাপ প্রবল বিরুপ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। পরিবেশ তার অন্যতম ক্ষেত্র। কারণ ইটিপি বা এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যাপ্ট অধিকাশ ওয়াশিং প্ল্যান্ট শিল্পে না থাকায় উৎপাদনে ব্যবহৃত পানি নানা রাসায়নিক উপাদানে দুষিত হয়ে সরাসরি খাল, বিল ও নদীতে পড়ছে। আমাদের দেশে কোন কিছু চরমে না উঠলে তাতে মনোযোগ দেয়া হয় না ।এই আইন বলবৎ করার সামর্থ্য অর্জন করা কর্তৃপক্ষের জন্য এক অলীক কল্পনা। তাছাড়া সামগ্রিক দুর্নীতির কারণে পরিবেশ আইন বলবৎ করা কারো পক্ষেই মুলত সম্ভব নয়। মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় ও এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নি”্ছে না।ু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য মৎস্য খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে নানাবিধ দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলেন।
বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে উন্নীতকরণের লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশের সব সরকার মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি,জেলেদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, মৎস্য অভয়াশ্রম ও সংরক্ষিত এলাকা স্থাপন,ইলিশ সম্পদের সংরক্ষণ, সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা বিকাশে সামুদ্রিক মাছের মজুদ নিরুপণ ও স্থায়িত্বশীল আহরণ, মৎস্য ও মৎস্যপণ্যের ভ্যালুচেইন উন্নয়ন,রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণসহ নানাবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে থাকে। দেশের মোট জিডিপি’র ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপি’র ২২ দমমিক ২৬ শতাংশ মৎস্য উপখাতের অবদান। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ ২ কোটি তথা প্রায় ১২ শতাংশের অধিক মানুষ মৎস্য খাতের বিভিন্ন কার্যক্রম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে।মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘দ্যা স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ আ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২৪’শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে অভ্যন্তরিণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ ২য়,বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম এবং ইলিশ উৎপাদনে ১ম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে ৪র্থ অবস্থানে রয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরিণ জলাশয়ে দেশীয় মাছ সংরক্ষণে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয় নানামূখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ৩৯ প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্ত প্রায় মাছের প্রজনন কৌশল ও চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে,প্রতিষ্ঠা করেছে ১০২ প্রজাতির দেশীয় মাছের লাইভ জিন ব্যাংক।উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে নিয়মিতভাবে পোনা মাছ অবমুক্তি ও বিল নার্সারি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিপন্নপ্রায় মৎস্য প্রজাতি সংরক্ষণ, অবাধ প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বর্তমানে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৪৯৪টি অভয়াশ্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বের ৫০টিরও অধিক দেশে বাংলাদেশ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে।বিশ্ববাজার আর্থিক মন্দাবস্থা থাকা সত্বেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৭৪০৮ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ৪০৫.৭২ মিলিয়ন ইউএস ডলার ( অর্থাৎ প্রায় ৪৪৯৬.৩৮ কোটি টাকার সমমূল্যের) বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হয়েছে।আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশীয় প্রজাতির সকল মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধকরণের জন্য গণমাধ্যম বিগত সময়ে বলিষ্ঠ ভ’মিকা পালন করেছে। দেশীয় জাতের মাছসহ অন্যান্য জলজসম্পদের নিরাপদ ও স্থায়িত্বশীল উৎপাদন নিশ্চিত করার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা বিধান, পুষ্টি ও চাহিদা পূরণ,রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর কাঙ্খিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে সমৃদ্ব বাংলাদেশ গড়তে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা জরুরী।
গাজীপুরে এক সময়ের খরস্রোতা ঐতিহ্যবাহী তুরাগ নদ আজ যেন বিষাক্ত এক নালা। কোথাও কেমিক্যাল মেশানো দুর্গন্ধময় কালো পানির স্রোত, কোথাও ময়লা-আবর্জনার স্তপ মিলিয়ে এটি এখন এক ভয়াবহ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। নদীর বর্তমান চিত্র দেখে নতুন প্রজন্মের কাছে একে ‘নদী’ বলাটাও যেন অবান্তব, তাদের কাছে এটি যেন একটি মরা খাল। ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন তুরাগ নদ এক সময় রাজধানী ঢাকা ও টঙ্গীর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান জলপথ ছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী, মোগল আমলে ঢাকার শহর বন্দর ছিল তুরাগ তীরেই। নদীটির ঐতিহ্য ও অতীত গৌরব নিয়ে দ্বিমত নেই কারও। তবে আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। নদীটির এমন করুণ অবস্থার জন্য দায়ী মূলত টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীর কিছু অসাধু শিল্প-প্রতিষ্ঠান। শিল্পনগরীর ভেতরকার ড্রেনেজ লাইনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিষাক্ত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তুরাগে। অধিকাংশ কারখানারই ইটিপি (এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) নেই বা থাকলেও তা সচল নয়। এই নদীতে এক সময় রুই, কাতলা, বোয়ালসহ সব ধরনের দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। এখন শুধু পাওয়া যায় সাকার ফিশ, যেগুলো ময়লা খায়। নদীতে গন্ধে দাঁড়ানো যায় না। বিসিক এলাকাটা তুরাগ পাড়ে হওয়ায় কারখানা মালিকরা তাদের বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি সরাসরি তুরাগে ফেলে দিচ্ছেন। এতে তুরাগ দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন এটাকে দেখলে সবাই বড়জোর ড্রেন বলেই সম্বোধন করবে। বিসিকের ভেতরে শতাধিক ওয়াশিং ও ডাইং কারখানা রয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশেরই পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব কারখানা থেকে অনায়াসেই তুরাগে ফেলা হচ্ছে রঙ, অ্যাসিড ও কেমিক্যালযুক্ত বিষাক্ত তরল বর্জ্য। অথচ এসব রিসাইকেল করার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে ইটিপি চালু থাকার কথা। ইটিপি কখনোই চালু করা হয় না। মাঝে মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোক আসে, তখন সাময়িক কিছু দেখিয়ে দেওয়া হয়। বাস্তবে বর্জ্য সরাসরি ড্রেন হয়ে যায় নদীতে। এক্ষেত্রে দরকার তদারকি ও কঠোর অভিযান। পরিবেশবিদদের মতে, ইটিপি ছাড়া কারখানা চালানোর অর্থ হলো পরিবেশের ওপর খোলা আঘাত। কেমিক্যালযুক্ত তরল বর্জ্য নদীর অক্সিজেন স্তর ধ্বংস করে ফেলে, ফলে পানিতে প্রাণী বাঁচে না। নদীর তলদেশে জমে থাকা ভারী ধাতব বিষক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আশপাশের জমিও। তুরাগ নদী বাঁচাতে দরকার কঠোর তদারকি, অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
লেখক: বিএনপি নেতা, ঢাকা
আমার বার্তা/মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন আপন/এমই