আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ও ভালোবাসার দিবসটি হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। কারণ ১৯৭১ সালের এই দিনেই আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করে চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিলাম। প্রতিবছর এই দিনটি ঘুরে ঘুরে আমাদের মাঝে হাজির হয় নতুন রূপে, নতুন সাজে ও নতুন ভাবনায়। নতুন প্রজন্মের তরুণরা সরাসরি বিজয় দেখেনি; কিন্তু তারা শুনেছে সেই বিজয়ের আত্মকথা। তবে এ বছর কোটা সংস্কার আন্দোলন ও এর ধারাবাহিকতায় অসহযোগ আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত সফল আন্দোলন। তরুণদের নেতৃত্বে দল মত ধর্ম বর্ণ জাতি নারী পুরুষ সবাই মিলে আন্দোলনকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। অবশ্য বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন যা পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলন ২০২৪ রুপ নেয় যেটি দেশে বিদেশে ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থান বা জুলাই বিপ্লব হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি পায়। ঘটনার সূত্রপাত যদিও ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়, এই আন্দোলনে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার দমন নিপড়ন শুরু করলে এটি অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। এই গণঅভ্যুত্থানের কারণে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থান বা জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দাবীদার আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার পর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার দাপটে একটি রায়ের দোহাই দিয়ে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। এরপর রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলটি পরপর আরও তিনটি এক তরফা জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করে এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক কারচুপি ও পাতানো নির্বাচনের অভিযোগ উঠে। এ সময় সরকার তাদের বিরোধীদের উপর ব্যাপক নির্যাতন, হত্যা, গুম ও ধর-পাকড় চালায়, বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের বিভিন্ন সাজানো মামলায় সাজা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের নেতৃত্বশূন্য করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এ সময়ে বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমে তথ্য প্রচার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর মতো আইনের মাধ্যমে কঠোরভাবে জনসাধারণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এ সময়ে অসংখ্য অরাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে সরকার পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি দলটির অঙ্গ সংগঠন বিশেষত ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে। ছাত্র সংগঠনটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সহিংসতামূলক কর্মকান্ড ও দমন-নিপড়নের ব্যাপক অভিযোগ উঠে। গত সাড়ে ১৫ বছরে দলটির ছোট থেকে কেন্দ্রের বেশিরভাগ নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থে কানাডায় বাংলাদেশিদের পরিবাবের সদস্যদের নিয়ে বেগমপাড়া তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে, পাশাপাশি বিগত দুই বছর ধরে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে, পাশাপাশি রিজার্ভের ঘাটতি, দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ পাচার, ব্যাংকিংখাতে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের জন্য সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দিনে দিনে জীবন-যাপন কঠিন হয়ে উঠেছিলো, যার কারণে তারা সরকারের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ ছিল সুদীর্ঘ। প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। ব্রিটিশদের শাসন-শোষণের অবসান ঘটলেও বাঙালির শোষণ মুক্তি ঘটেনি। পশ্চিম পাকিস্তানিরা শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালির ওপর শোষণ, দমন চালাতে থাকে। তারা আঘাত হানে মাতৃভাষার ওপর। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন এক স্বাধীন দেশের জন্ম দিলেও স্বাধীনতার পর পরই দলটির দুঃশাসন আর অপরাজনীতির কারণে বিজয়ের আনন্দ অনেকটা ম্লান হয়ে যায়। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দাবীদার দলটি কতটা অগণতান্ত্রিক ও জনসমার্থণহীন হলে হত্যা, গুম, হামলা, মামলা, লুটপাটে মেতে উঠতে পারে তা '২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করলে সহজেই অনুমেয়। একটি জননন্দিত দল কতটা ভয়াবহ ও নির্মম হলে জননিন্দিত কাজ মানুষ হত্যা করে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়, তা তরুণদের '২৪ গণঅভ্যুত্থান এর জ্বলন্ত উদাহরণ।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ’৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। জন্ম হয় নতুন লাল সবুজের বাংলাদেশ। শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ, মহান মুক্তিযুদ্ধ। এরপর দীর্ঘ নয় মাস সারা দেশে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার সহযোগীদের গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে।
একাত্তরে যারা বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিল তাদেরও সিংহভাগ ছিলেন তরুণ। তাই স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের ওপর। এ তরুণ প্রজন্মই '২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছি। এখন যারা তরুণ তাদেরও অনুভবে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শানিত চেতনা। সেই চেতনা নিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, তারপরও আমরা সাম্প্রতিককালে অনেক এগিয়ে গিয়েছি। এজন্যই বারবার বলা হয়, বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে তরুণেরা। সেই এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাবেন প্রবীণেরা। এ যুগ প্রতিযোগিতার। প্রতিযোগিতা মানে লড়াই। লড়াইয়ের জন্য চাই সাহস। আর সেই সাহস সঞ্চারিত করতে দরকার একটি সাহসী নেতৃত্ব।
মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সূর্য্য সন্তান হিসেবে অভিহিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা হাজার বছরের সংগ্রামের পরিণতি। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী বাঙালি হৃদয়ে চিরজাগরূক হয়ে থাকবে। তাদের আত্মত্যাগের ফসল নষ্ট হয়নি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধসহ স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সব বীর শহীদের বীরত্বগাথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। চিরতারুণ্যের লাল সবুজের পতাকা সগৌরবে উড়তে থাকবে হাজার বছর, যুগ যুগ ধরে অনন্ত কাল।
নতুন প্রজন্মের সবাইকে বিজয় দিবসের অর্জনকে হৃদয়ে ধারণ করে নতুনদের কাছে বিজয় দিবসের কথা তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নির্যাতন- নিষ্পেষিত হওয়ার কথা জানাতে হবে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর যে কামানের গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অসংখ্য প্রাণের আত্মদান, অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, তা জানলে শিউরে উঠবে তরুণপ্রাণ। দেশের প্রতি জাগবে তাদের ভালোবাসা, উজ্জীবিত হবে দেশপ্রেমে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীনতা উপভোগ করছি, বিজয় উল্লাসে মেতে উঠছি। না হলে সারাজীবনই পাকিস্তানি শাসকদের বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকতে হতো। কিন্তু এখনো অনেক ক্ষেত্রে আমাদের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা আসেনি। পাশ্ববর্তী একটি দেশের আধিপত্যের থাবা নতুন প্রজন্মকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাদের কাছে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে, স্বাধীনতা রক্ষা করা আরও কঠিন। '২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে তরুণরা দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হয়। প্রতিটি নাগরিক যাতে স্বাধীনতার পূর্ণ সাধ উপভোগ ও উপলব্ধি করতে পারে সে ব্যবস্থা ভবিষ্যতেও তাদের করতে হবে।
২০২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানে তরুণরা নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতার নতুন স্বাদ উপলব্ধি করছে। এতদিন ইতিহাস ছিল একটি দল ও পরিবার কেন্দ্রীক এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ছিল তাদের তোষামোদিতে ভরপুর। মুক্তিযুদ্ধের অনেক নায়ককে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। পাশ্ববর্তী একটি দেশ দলটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনটি ভোটারবিহীন অস্বচ্ছ নির্বাচনকে একচ্ছত্র সমর্থন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল। দলটি যখন '২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে দলবলসহ পালিয়ে গেল তখন পাশ্ববর্তী দেশটির আসল চরিত্র উন্মোচিত হলো। দেশটি মূলত তাদের আধিপত্য বিস্তার এবং বাংলাদেশকে সিকিমের মতো ব্যবহার করার জন্যই যে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, এর আসল উদ্দেশ্য '২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিষয় নিয়ে অনেকের মধ্যেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। যেমন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বা সরকার ঘনিষ্ঠ কারও কারও কথাবার্তা থেকে একটি বিষয় উঠে আসছে, আর তা হচ্ছে, ১৯৭১-কে ছোট করার প্রবণতা। কারও কারও কথাবার্তা বা তৎপরতায় তা দেখা যাচ্ছে। অথচ ১৯৭১ আর ২০২৪-কে মুখোমুখি দাঁড় করানোর কিছু নেই। ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান হচ্ছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের একটা ধারাবাহিক প্রেক্ষাপট। মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা এতদিন বাস্তবায়ন হয়নি, তা বাস্তবায়ন করার জন্যই মানুষ বারবার লড়াই করছে। আর বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে হলে অবশ্যই এটি নিশ্চিত করতে হবে যে– ধর্ম, লিঙ্গ, জাতি, শ্রেণিগত বৈষম্যের যে জায়গাগুলো আছে সেটি কোনোভাবেই যেন মাথাচাড়া না দেয়। পতিত স্বৈরাচারী দলটি স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিজেদের মতো তৈরি করার যে অপচেষ্টা বিগত সময়ে করেছিল সেই লড়াইয়েরই আরেকটা পর্ব হচ্ছে ২০২৪ সালের এ গণঅভ্যুত্থান। সুতরাং এ গণভ্যুত্থানকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বাঁক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা হিসেবেই দেখা দরকার।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট।
আমার বার্তা/মো. জিল্লুর রহমান/এমই