
অর্থনৈতিক অবস্থান সূচক প্রণয়নের উদ্যোগ ঢাকা চেম্বারের। ঢাকা চেম্বারে “অর্থনৈতিক অবস্থান সূচক” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত।
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতি-প্রকৃতির বাস্তবচিত্র উদ্ঘাটনের মাধ্যমে বিদ্যমান অবস্থা উন্নয়নে করণীয় নির্ধারণে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) “অর্থনৈতিক অবস্থান সূচক” প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারিখাত সংশ্লিষ্টদের মতামত ও পর্যবেক্ষণ প্রাপ্তির লক্ষ্যে ঢাকা চেম্বার অদ্য ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ তারিখে “অর্থনৈতিক অবস্থান সূচক” শীর্ষক ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
আলোচনা সভার স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, দেশে ব্যবসায়িক পরিবেশ পরিমাপের জন্য স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বেশকিছু সূচকের কার্যক্রম রয়েছে, যদিও এসব সূচক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে এবং কেন পরিবর্তিত হচ্ছে তার প্রকৃত চিত্র স্পষ্টভাবে তুলে ধরছে না, এপ্রেক্ষিতে ডিসিসিআই ‘অর্থনৈতিক অবস্থান সূচক’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে এবং প্রাথমিকভাবে এর কার্যক্রম রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক হলেও পরর্বতীতে ধাপে ধাপে সারাদেশে সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ত্রৈয়মাসিক ভিত্তিকে প্রকাশিতব্য এ সূচকের মাধমে বিশেষকরে শিল্পখাতে উৎপাদন, বিক্রয়, অর্ডার প্রবাহ, রপ্তানির প্রবণতা, কর্মসংস্থান, ব্যবসায়িক আস্থা এবং বিনিয়োগের প্রবৃত্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া পাবে। এছাড়াও প্রাথমিকভাবে এ সূচকে তৈরি পোষাক, টেক্সটাইল, পাইকারী ও খুচরা বাণিজ্য, আবাসন, পরিবহন ও স্টোরেজ এবং ব্যাংক খাতের তথ্য অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে বলে তিনি অভহিত করেন।
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা চেম্বারের মহাসচিব (ভারপ্রাপ্ত) ড. একেএম আসাদুজ্জামান পাটোয়ারী, যেখানে তিনি বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ সময়ে এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়, যেখানে মোট ৬৫৪ জন উত্তরদাতার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে উৎপাদন খাত থেকে ৩৬৫ জন এবং সেবা খাত থেকে ২৮৯ জন। তিনি জানান, আটটি উৎপাদন শিল্প থেকে বাছাই করা হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে খাদ্য পণ্য, টেক্সটাইল, তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, ঔষধি রাসায়নিক ও উদ্ভিজ্জ পণ্য, রাবার ও প্লাস্টিক পণ্য, অন্যান্য অ-ধাতব খনিজ এবং মৌলিক ধাতু, এছাড়াও পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য, স্থল পরিবহন এবং রিয়েল এস্টেট কার্যক্রম ৩টি সেবা খাত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, গবেষণায় দেখা যায় ঢাকা জেলার অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল খাতের অবদান ৫৬ শতাংশ, ৪৪ শতাংশ সেবা খাতের। এছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিস্থিতির উন্নয়ন, শিল্পখাতে নিরবিচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ, আর্থিক খাত সুসংহতকরণ, ঋণ প্রদানের প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও সুদের হার হ্রাস, বাণিজ্য সহায়ক অবকাঠামো সেবা নিশ্চিতকরণ, স্থানীয় পর্যায়ের সাপ্লইচেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণ, আমদানি-রপ্তানি পণ্যের উপর ভ্যাট হার হ্রাস ও রাজস্ব প্রদানের প্রক্রিয়া সহজীকরণ প্রভৃতি বিষয়গুলোর সরকারের সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি আবুল কাসেম খান ও আশরাফ আহমেদ, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন (এনপিও)-এর মহাপরিচালক মোঃ নূরুল আলম, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাপোর্ট টু সাসটেইএ্যাবল গ্রাজুয়েশন প্রজেক্ট (এসএসজিপি)-এর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ নেসার আহমেদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি অধিশাখা) ড. সৈয়দ মুনতাসির মামুন, অর্থমন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (বাজেট পরিবীক্ষণ শাখা) ড. এ.কে.এম আতিকুল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (এসএমইএসপিডি) নওশাদ মোস্তফা, পরিচালক (গবেষণা) ড. মোঃ সালিম আল মামুন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম, র্যাপিডের গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোঃ দীন ইসলাম, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইএসএস)’র গবেষণা পরিচালক ডা. মোহম্মদ জসিম উদ্দিন এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি)-এর সিনিয়র প্রাইভেট সেক্টর স্পেশালিষ্ট মিয়া রহমত আলী প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, তৈরি পোষাক খাত অনেক ধরনের সুবিধা বেশি পাচ্ছে, তাই এর সাথে অন্যান্য খাতের তুলনার বিষয়টি তেমন যৌক্তিক নয়। তিনি বলেন, দেশের এসএমইরা কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থনীরিত মূল চালিকা শক্তি, যদিও এখাতের উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন আশানুরূপ নয়। ডিসিসিআই’র ইনডেক্সেও বিষয়ে তিনি বলেন, তথ্য বিশ্লেষনের বিষয়টি শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে করলে হবে না, আমাদের প্রতিযোগি দেশের সাথে এর তুলনামূলক মূল্যায়ন জরুরী। অর্থনীতির সকল সূচকে বাংলাদেশের অবস্তা বেশ নাজুক, এর অন্যতম কারণ হলো সরকার প্রস্তাবিত সংষ্কার কার্যক্রমগুলো ভালে ভাবে মূল্যয়ন করছে না পাশাপাশি দীর্ঘসূত্রিতা পরিলক্ষিত হবে এবং এ অবস্থা মোকাবেলায় অর্থনৈতিক সংষ্কার প্রস্তাবকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টিতে ডিজিটাল কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা গেলে সময় ও হয়রানি দুটোই হ্রাস হবে বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন।
এনপিওর মহাপরিচালক মোঃ নূরুল আলম বলেন, গবেষণা কার্যক্রমে তথ্য সংগ্রহে আরো সচেতন হতে হবে, যা প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়নে আরো সহায়ক হবে এবং শিল্প সংশ্লিষ্ট সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি কি ধরনের প্রভাব ফেলে তা নির্ধারণের উপর জোরারোপ করা আবশ্যক।
ডিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি ও পরিচালক আশরাফ আহমেদ এ গবেষণায় সংগৃহীত তথ্যের পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণে আরো মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি জরিপটির গবেষণা কার্যক্রমের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
এসএসজিপি’র আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ নেসার আহমেদ বলেন, এলডিসি উত্তরণের আগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিদ্যমান সুবিধার বেশিরভাগই বাংলাদেশ ব্যবহার করেছে, তাই এলডিসি উত্তরণ পরবতী সময়ে এ সুবিধা বঞ্চিত হওয়া পরিবেশ মোকাবেলায় আমাদের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও তিনি গবেষণার প্রশ্নপত্র সংশোধনের প্রস্তাব করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মুনতাসির মামুন বলেন, অর্থনীতি, শিল্পখাত, সরকারী ও বেসরকারি সংস্থার উপর বিদেশি উদ্যোক্তাদের আস্থা থাকলেই, বিনিয়োগ প্রাপ্তির পাশাপাশি বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারণ সম্ভব। তিনি কৃষিখাতকে এ গবেষণায় অর্ন্তভূক্তির আহ্বান জানান, যা দেশের অন্যমত বড় খাতের অবস্থা নির্ণয়ে সহায়ক হবে।
বিএফটিআই’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. সাইফ উদ্দিন আহমেদ দেশের বিভিন্ন সংস্থার তথ্যের সাথে ঢাকা চেম্বারের গবেষণার তথ্যের সমন্বয়ের উপর জোরারোপ করেন, সেই সাথে এ গবেষণায় খাত ভিত্তিক আরো বহুমুখী তথ্যের সংযোজনের সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। এছাড়াও হালকা প্রকৌশল, সেবা খাত সহ অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে এ জরিপে সম্পৃক্ত করার তিনি প্রস্তাব করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (এসএমইএসপিডি) নওশাদ মোস্তফা বলেন, এসএমইদের জন্য নীতিমালা ইতোমধ্যে বেশ সহজীকরণ করা হয়েছে, তবে ঋণ প্রাপ্তিতে কি ধরনের সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে, উদ্যোক্তাদের থেকে এধরনের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সে অনুযায়ী উদ্যোগ গ্রহণ সহজতর হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক (গবেষণা) ড. মোঃ সালিম আল মামুন বলেন, পরবর্তীতে জেলা ভিত্তিক তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কৃষিখাতের তথ্য জরুরী, তাই এ গবেষণায় এখাতের তথ্য সম্পৃক্তকরণের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠিত ফর্মুলা ব্যবহার করে এ গবেষণাটি পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, সেই সাথে প্রসিদ্ধ কোন জার্নালে পরিচালিত গবেষণার সার-সংক্ষেপ প্রকাশের উদ্যোগী হওয়া জরুরী।
র্যাপিডের গবেষণা পরিচালক ড. মোঃ দীন ইসলাম বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পরিচালিত গবেষণার কার্যপদ্ধতি সংশোধন করা যেতে পারে।
বিআইএসএস’র গবেষণা পরিচালক ডা. মোহম্মদ জসিম উদ্দিন ডিসিসিআই’র পরিচালিত গবেষণার নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতিতে সংশোধনের প্রস্তাব করেন, যার মাধ্যমে আরো বিস্তারিত তথ্য সংযুক্ত করা সম্ভব হবে।
আইএফসি-এর সিনিয়র প্রাইভেট সেক্টর স্পেশালিষ্ট মিয়া রহমত আলী জানান, সরকার নতুন ইনসলভেন্সিং এ্যাক্ট প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে, যা বাণিজ্যিক প্রক্রিয়াকে সহজতর করবে, এছাড়াও গবেষণায় উপস্থাপিত তথ্য দেখা যায় আমাদের উদ্যোক্তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বেশ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে, তবে এ পরিবর্তনটা কেন হল তার কারণ জানা গেলে সহায়ক নীতি প্রণয়ন সহজতর হবে।
ডিসিসিআই’র সহ-সভাপতি মোঃ সালিম সোলায়মান সহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
আমার বার্তা/এল/এমই

