বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড পাটখাত এখনো বৈদেশিক মুদ্রা আয়, কৃষিজ পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং পরিবেশবান্ধব শিল্প গড়ে তোলার অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত এটি। কিন্তু নানা নীতিগত সিদ্ধান্ত, বৈদেশিক বাজারে প্রতিযোগিতা ও প্রণোদনা হ্রাসের কারণে এ খাতটি চাপে পড়ছে। এর মধ্যেই কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যে মাশুল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নতুন করে দুশ্চিন্তা তৈরি করেছিল। অবশেষে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার।
সম্প্রতি কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে সরকার। এর ফলে পূর্বের হারেই এই খাতে মাশুল আদায় করা হবে। গত ২৬ জুন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের পূর্বঘোষিত প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নতুন করে নির্দেশনা জারি করা হয়, যাতে বলা হয়েছে পূর্বের হার অনুযায়ীই ব্যাংকগুলোকে মাশুল আদায় করতে হবে।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। তাতে কাঁচা পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতি বেলের মাশুল ২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল যা প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি। একইভাবে, পাটজাত পণ্যে প্রতি ১০০ টাকা রপ্তানির বিপরীতে মাশুল ১০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৫০ পয়সা করা হয়েছিল, অর্থাৎ পাঁচ গুণ বৃদ্ধি। তবে ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার আগেই সরকার তা প্রত্যাহার করল। এর আগে ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে সর্বশেষ এ মাশুল হার নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রায় ৩০ বছর পর হঠাৎ মাশুল বাড়ানোর সিদ্ধান্তে খাতসংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ জানালে সরকার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করে।
বাতিল করা প্রজ্ঞাপনে স্পষ্টভাবে বলা হয়, '৭ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে জারি করা মাশুল নির্ধারণসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করা হলো। এতে আরও বলা হয়, 'পূর্বের ন্যায় প্রতি বেল কাঁচা পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে ২ টাকা এবং পাটজাত পণ্যে প্রতি ১০০ টাকার রপ্তানি মূল্যের বিপরীতে ১০ পয়সা হারে রাজস্ব আদায় করা হবে।'
শুধু মাশুল নয়, এই খাতে নগদ সহায়তাও কমিয়ে এনেছে সরকার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দিন থেকেই বৈচিত্র্যময় পাটপণ্যে নগদ সহায়তা ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। সাধারণ পাটজাত পণ্যে ৭ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশ এবং পাট সুতায় ৫ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়। ফলে একাধিক সিদ্ধান্তে পাটখাতের রপ্তানিকারকেরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
একসময় বাংলাদেশি পাটপণ্যের প্রধান গন্তব্য ছিল ভারত। কিন্তু ভারত সরকার অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করায় সেখানে পাট সুতা রপ্তানি প্রায় ৮০ শতাংশ কমেছে। এখন সে বাজারে প্রবেশ কঠিন হয়ে পড়েছে, যদিও ভারতের বাজার থেকে এখনো সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ছিল ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৯১ কোটি ১৫ লাখ ডলারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরও কমে ৮৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার হয় এবং সদ্য বিদায়ি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ৮২ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) সূত্র বলছে, দেশে বছরে প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ৬০ লাখ বেল প্রয়োজন হয় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের জন্য। পাট অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১৩টি দেশে ১৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৫ বেল কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে। এতে আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৪ লাখ ৮৭ হাজার মার্কিন ডলার, যার মধ্যে ৯ কোটি ডলারের বেশি এসেছে ভারত থেকে।
আমার বার্তা/এল/এমই