চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের গানটাংকিংয়ে ৩ লাখ বছরের পুরোনো কাঠের সরঞ্জামের এক বিরল ভান্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
চীনের জিয়াংচুয়ানের ইউনান প্রদেশের গানটাংকিং প্রত্নতাত্ত্বিক হ্রদের তীরে অক্সিজেনবিহীন কাদামাটির পলিতে এই দুর্লভ কাঠের সরঞ্জামগুলো সংরক্ষিত ছিল। গবেষকরা পলির মধ্যে প্রায় ১ হাজার জৈব অবশেষও খুঁজে পেয়েছেন। উন্নত কৌশল ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এই সরঞ্জামগুলোর বয়স আড়াই লাখ থেকে সাড়ে ৩ লাখ বছরের মধ্যে নির্ধারণ করেছেন।
বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এই চাঞ্চল্যকর গবেষণাটি পূর্ব এশিয়ার আদিম মানব পূর্বপুরুষদের উন্নত জ্ঞানীয় দক্ষতা, তাদের জীবন, খাদ্যাভ্যাস এবং পরিবেশ সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘অত্যন্ত বিরল’ এই কাঠের সরঞ্জামগুলো বিভিন্ন আকার ও কার্যকারিতার এবং এগুলো প্রায় ৩ লাখ বছরের পুরোনো স্তর থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। এই অঞ্চলের আদিম মানুষ তাদের টিকে থাকার জন্য মূল ও কন্দের মতো মাটির নিচের উদ্ভিদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল। এখন পর্যন্ত এই সময়ের কাঠের সরঞ্জামের মাত্র দুটি আবিষ্কারের কথা জানা যায়। যার একটি ইউরোপে এবং অন্যটি আফ্রিকায়। এই নতুন আবিষ্কারটি বিশ্বজুড়ে আদিম মানুষের মধ্যে কাঠের সরঞ্জামের ব্যবহারের ব্যাপকতা প্রমাণ করে।
নব-আবিষ্কৃত লাঠিগুলোর মধ্যে দুটি ইতালির পোগেত্তি ভেক্কি সাইটে পাওয়া ১ লাখ ৭১ হাজার বছরের পুরোনো লাঠিগুলির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এছাড়াও, চারটি অনন্য হুক-আকৃতির সরঞ্জাম আবিষ্কৃত হয়েছে, যা সম্ভবত শিকড় কাটার জন্য ব্যবহৃত হত বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
গবেষকরা কাঠের সরঞ্জামগুলোতে ইচ্ছাকৃত মসৃণতা, ঘষা লাগার চিহ্ন এবং সরঞ্জামের প্রান্তে মাটির অবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। এটি নির্দেশ করে যে এই সরঞ্জামগুলো কন্দ ও শিকড়ের মতো মাটির নিচের গাছপালা খননের জন্য ব্যবহৃত হত।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কাঠের সরঞ্জামগুলির মধ্যে খননকারী লাঠি এবং ছোট, সম্পূর্ণ, হাতে ধরা সূক্ষ্ম সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই আবিষ্কারের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে পূর্ব এশিয়ার এই আদিম মানব পূর্বপুরুষরা সম্ভবত উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাদ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। সাইটটিতে পাইন নাট, হ্যাজেলনাট, কিউই ফল এবং জলজ কন্দের প্রমাণও পাওয়া গেছে। এর বিপরীতে, ইউরোপ এবং আফ্রিকায় আবিষ্কৃত এই সময়ের কাঠের সরঞ্জামগুলো ছিল মূলত শিকারের উপকরণ, যেমন বর্শা এবং বর্শার ফলা।
এই গবেষণার সহলেখক, প্রত্নতত্ত্ববিদ বো লি জানিয়েছেন, এই আবিষ্কার আদিম মানুষের অভিযোজন সম্পর্কে পূর্ববর্তী ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে। সমসাময়িক ইউরোপীয় সাইটগুলো (যেমন জার্মানির শনিঙ্গেন) বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী শিকারের উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করলেও, গানটাংকিং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে একটি অনন্য উদ্ভিদ-ভিত্তিক টিকে থাকার কৌশল প্রকাশ করে।
লি মনে করেন, কাঠের সরঞ্জামগুলোর বৈচিত্র্য এবং পরিশীলন প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ডে একটি উল্লেখযোগ্য শূন্যতা পূরণ করে, কারণ আফ্রিকা এবং পশ্চিম ইউরেশিয়ার বাইরে ১ লখ বছরের পুরোনো কাঠের সরঞ্জাম অত্যন্ত বিরল।
এই আবিষ্কারটি কেবল কাঠের সরঞ্জামের বৈশ্বিক ব্যবহারই প্রমাণ করে না, বরং এটি ইঙ্গিত দেয় যে প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতিগুলো তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে স্থানীয়ভাবে উপযোগী সরঞ্জাম তৈরি করেছিল। এটি মানব সভ্যতার বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে।
সূত্র: আইএফএল সায়েন্স
আমার বার্তা/এল/এমই