সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো থেকে গত মে মাস পর্যন্ত ৫৪টি মন্ত্রণালয়ে ১২৯টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
শুক্রবার (৬ জুন) পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এ তথ্য জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পর এ সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ। ভয়ংকরভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতিও এতটা খারাপ থাকে না, যতটা খারাপ করে দিয়েছে ১৬ বছরের লাগামহীন লুটপাটতন্ত্র। আশার বিষয় হচ্ছে শুধু ব্যাংক নয়, প্রত্যেকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জনগণের আমানত এখন নিরাপদ। অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক ইতিবাচক ধারায় ফিরে এসেছে। আমাদের অর্থনীতির ইতিবাচক ধারা বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও আকৃষ্ট করছে।
তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্যে নেমে যাওয়ার ভয়ে পতিত সরকার বিদেশি ব্যবসায়ীদের আয় নিজ দেশে নিতে দিচ্ছিল না। আমরা সেটা নিরসন করেছি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ইতিবাচক অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এ অর্থবছরে আমরা চেষ্টা করেছি এমন একটি বাজেট দিতে যা সত্যিকার অর্থে জনকল্যাণমুখী হয়। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি বাজেট তার আগের বছরের চেয়ে ছোট হয়েছে।
প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। এই বাজেট প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান নয়, এই বাজেটে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে মানুষকে। নজরদারি বৃদ্ধির ফলে রপ্তানি আয় বেড়েছে। অর্থনীতির দুঃসময়ে আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনেরা রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসেবে এগিয়ে এসেছেন, যার ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি জাতির পক্ষ থেকে সকল রেমিট্যান্স যোদ্ধাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অর্থ পাচার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এছাড়া পুরোনো আমদানি দায় পরিশোধ হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও চাপ কমে এসেছে। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ এবং ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটি একটি বড় কাঠামোগত সংস্কার। এই সিদ্ধান্তের ফলে বিশাল আকারের দুর্নীতি কমবে, রাজস্ব ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়বে, স্বার্থের দ্বন্দ্ব কমবে এবং রাজস্ব আহরণের আওতা সম্প্রসারিত হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অর্থনীতিসহ বিগত মাসগুলোতে সরকারের প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয় ছোট-বড় বহু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। মোট ৫৪টি মন্ত্রণালয়ে এক হাজারেরও ওপরে সংস্কার ও উন্নয়নসংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি আমরা যে সংস্কার কমিশন করেছিলাম, তাদের সুপারিশের মধ্য থেকে আশু করণীয় সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়গুলো কাজ করে যাচ্ছে। মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন থেকে প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে ৫৪টি মন্ত্রণালয়ে ১২৯টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এ সকল সংস্কারকাজের মধ্যে কয়েকটি চুম্বক অংশ আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।
আইন ও বিচার বিভাগ মোট ৩৩টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবুনালস) অ্যাক্ট ১৯৭৩ সংশোধন ও পুনর্গঠন করে আইনটি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ ২০২৫ প্রণয়ন ও জারি করা হয়েছে। এর অধীনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন করা হয়েছে। যার ফলে এখন বাদীকে আর দিনের পর দিন সশরীরে আদালতে যেতে হবে না। একেকটি দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হতে আগে যত সময় লাগত, এই সংশোধনীর ফলে সময়সীমা অর্ধেকে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করছি।
দেশের এক হাজারের বেশি অবকাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানের নাম পলাতক প্রধানমন্ত্রীর বাবা-মা-ভাই-বোন-আত্মীয়স্বজনের নামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল সেনানিবাস, বিমানঘাঁটি, নৌবাহিনীর জাহাজ, মেগা সেতু, সড়ক, স্থাপনা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, গবেষণাকেন্দ্র—আরও বহু কিছু। এগুলো সব নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করা হয়েছে। প্রবাসী ভাই-বোনদের অনেকদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালা সংশোধন করা হয়েছে। এখন পুরোনো পাসপোর্টে ‘নো ভিসা রিকোয়ার্ড স্টিকার’ থাকলে কিংবা জন্মসনদ থাকলে বিদেশ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করা যাবে। আগামী দুই মাসের মধ্যে আইনগত সহায়তা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বিস্তার করা হবে। বছরে এখন গড়ে ৩৫ হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়, আমাদের লক্ষ্য এটিকে দুই লাখ মামলায় উন্নীত করা। মামলা দায়েরের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই যাদের বিরুদ্ধে মামলার কোনো ভিত্তি নেই, তাদের বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি দেশের মানুষকে লুটপাটতন্ত্র থেকে বের করে আনতে। আপনারা জানেন, বিগত ১৬ বছরে উন্নয়নের নামে মেগা প্রকল্প নিয়ে কী পরিমাণ লুটপাট হয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলো যেন হয়ে উঠেছিল মেগা ডাকাতির প্রকল্প। আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প পুনঃমূল্যায়ন করে দেখেছি যে প্রায় সব প্রকল্পেই ভৌতিক ব্যয় ধরা হয়েছে।
শুধুমাত্র সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ, রেল মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগড়-এই পাঁচটি বিভাগেই ৪৬ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা ব্যয় সংকোচ করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
ড. ইউনূস বলেন, এই টাকা দিয়ে জ্বালানি খাতে সমস্ত বকেয়া মিটিয়ে দিয়ে বকেয়ার পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনা হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করে সব ধরনের ঋণের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসাই আমাদের অগ্রাধিকার।
আমার বার্তা/এল/এমই