ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান এবং আল কোরআন সমগ্র মানবজাতির জন্য সর্বশেষ আসমানী কিতাব। কোরআনে বহু নবী রাসুলের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। কোরআনে বর্ণিত পূর্ববর্তী সকল নবী রাসুলদের প্রতি ঈমান আনা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত। খ্রিস্টানদের যিশুখ্রীস্টই কোরআনে বর্ণিত হযরত ঈসা (আ.) বনি ইসরাইলের সর্বশেষ নবী ও কিতাবধারী আল্লাহর রাসুল। দুই হাজারেরও বেশি বছর আগে তিনি ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে জন্মলাভ করেন। আল্লাহর বিশেষ কুদরতে পৈতৃক সম্পর্ক ছাড়াই তিনি কুমারী মায়ের গর্ভে জন্মলাভ করেন। প্রসিদ্ধ চার আসমানি কিতাবের মধ্যে ইঞ্জিল তাঁর ওপর নাজিল হয়। তাঁর আগের সব নবী ও আসমানি কিতাবের সত্যায়নকারী এবং সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) এর আগমনের সুসংবাদ দান করেন। পবিত্র কোরআনের ১৫টি সুরার ৯৮টি আয়াতে হযরত ঈসা (আ.) এর অলৌকিক জন্ম, ঈমানের দাওয়াত, ইহুদিদের ষড়যন্ত্র এবং আসমানে উঠিয়ে নেওয়ার ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।
সমগ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায় বিশ্বব্যাপী ২৫ ডিসেম্বর একইসাথে যিশুখ্রিস্ট বা হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মদিন পালন করে থাকে। এই প্রথা অনেক আগে থেকেই চালু হয়ে আসছে এবং এর উৎপত্তি সম্ভবত রোমান সম্রাজ্য থেকে। যদিও বর্তমান যুগে অবশ্য অনেক খ্রিস্টান স্কলারও বিশ্বাস করেন যে ২৫ ডিসেম্বর যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন নয়, তবু সবাই এটা পালন করে। বাইবেল এবং কোরআন অনুযায়ী ২৫ ডিসেম্বর যিশুখ্রিস্টের জন্ম দিন তো নয়ই, এমনকি জন্ম মাস ও নয়। পবিত্র কোরআন অনুসারে হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মের সময় হচ্ছে গ্রীষ্মকাল বা মধ্য গ্রীষ্মকাল। সূরা মরিয়মেরে ২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, 'আর তুমি নিজের দিকে খেজুর গাছের কান্ডে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার উপর সুপক্ক খেজুর পতিত হবে'। মধ্যপ্রাচ্যে খেজুর কখন পাকে? সাধারণত গ্রীষ্মকাল বা মধ্য গ্রীষ্মকাল। সুতরাং কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্মদিন কোনভাবেই ডিসেম্বর বা শীতকালে নয়।
হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর একান্ত কুদরতে পিতাহীন দুনিয়ায় আগমন করেন। পবিত্র কোরআনের সুরা মারইয়ামের প্রথম ৪০ আয়াতে সেই ঘটনার বিবরণ এসেছে। রাসুলের যুগে আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান বাদশাহ আসহামা নাজ্জাশি সুরা মারইয়ামের এই আয়াতগুলো শুনেই ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে আসমানি ধর্ম তথা ইসলাম, খ্রিস্ট ও ইহুদি ধর্মের বিশ্বাস হলো তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত রাসুল বা দূত। এ বিষয়ে বিশ্বাসের কোন বিরোধ নেই। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মারইয়ামের পুত্র মাসিহ রাসুল ছাড়া আর কিছু নয়। তার আগে বহু রাসুল অতিক্রান্ত হয়েছে আর তার জননী পরম সত্যনিষ্ঠ ছিল। তারা উভয়ে পানাহার করত। দেখো, আমি তাদের জন্য কিরূপ যুক্তি-প্রমাণ বর্ণনা করি; আবার দেখো, এরা উল্টা কোন দিকে যাচ্ছে।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৭৫)।
মহান আল্লাহ হযরত ঈসা (আ.) এর আগমন সম্পর্কে বলেন, 'যখন ফেরেশতাগণ বলল, হে মারইয়াম! আল্লাহ তোমাকে তাঁর এক বাণীর সুসংবাদ দিচ্ছেন, যাঁর নাম হলো মসীহ-ঈসা ইবনে মারইয়াম; দুনিয়া ও আখিরাতে তিনি মহাসম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। যখন তিনি মায়ের কোলে থাকবেন এবং পূর্ণ বয়স্ক হবেন, তখন তিনি মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন, আর তিনি সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। তিনি বললেন, পরওয়ারদেগার! কেমন করে আমার সন্তান হবে; আমাকে তো কোনো পুরুষ-মানুষ স্পর্শ করেনি। বললেন, এভাবেই। আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কোনো কাজ করার জন্য ইচ্ছা করেন তখন বলেন যে, 'হয়ে যাও', অমনি তা হয়ে যায়।' (সুরা আলে ইমরান : ৪৫-৪৭)
হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের চিন্তাধারার মধ্যে বাহুল্য ও স্বল্পতা বিদ্যমান। খ্রিস্টানরা তাঁর প্রতি অতি সম্মান দেখিয়ে তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র’ হিসেবে বিশ্বাস করে। অন্যদিকে ইহুদিরা তাঁর প্রতি এতটাই ধৃষ্টতা দেখিয়েছে যে তাঁকে ইউসুফ মিস্ত্রির ‘জারজ সন্তান’ আখ্যায়িত করেছে (নাউজুবিল্লাহ)। কোরআনের বর্ণনা মতে, তিনি আল্লাহর পুত্রও নন, আবার তিনি অবৈধভাবেও জন্মগ্রহণ করেননি, বরং তিনি অলৌকিকভাবে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি আল্লাহর পুত্র নন। তিনি আল্লাহর নবী, যেভাবে অলৌকিকভাবে ইয়াহইয়া (আ.) এর জন্ম হয়েছিল। মহান আল্লাহ স্ত্রী ও সন্তান থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।
হজরত ঈসা (আ.) মানুষকে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহ্বান করেছেন। তাদের মহান রবের একনিষ্ঠ পথ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, 'ঈসা যখন স্পষ্ট নিদর্শনসহ আগমন করল, তখন বলল, আমি তোমাদের কাছে প্রজ্ঞা নিয়ে এসেছি এবং তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছ, তা ব্যক্ত করার জন্য এসেছি। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার কথা মানো। নিশ্চয়ই আল্লাহই আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক। অতএব, তাঁর এবাদত করো। এটা হলো সরল পথ। ' (সুরা আয যুখরূফ : ৬৩-৬৪)।
খ্রিস্টানরা ‘ত্রিত্ববাদে’ বিশ্বাস করে। এটা তাদের বহুল আলোচিত ধর্মবিশ্বাস। ‘ত্রিত্ববাদ’ এর অর্থ হচ্ছে পিতা (গড), পুত্র (ঈসা মাসিহ) ও পবিত্র আত্মার সমন্বয়েই গড। তিনের মধ্যে একজন অংশীদার হলেন গড। এরপর তাঁরা তিনজনই এক এবং একজনই তিন। তিন এর সমষ্টি ‘এক’ কিভাবে হয়, এর কোনো যুক্তিসংগত উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই একাধিক গডের অস্তিত্ব নিয়ে পোপদের আমলেই বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রধানত হেলেনি ও গনোস্টীয় দার্শনিকদের শিক্ষা থেকে এর উদ্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে আন্তাকিয়ার পাদরি সিওফিলোস গ্রিক ভাষায় ‘ত্রিয়াস’ পরিভাষা ব্যবহার করেন।
হযরত ঈসা (আ.)কে খ্রিস্টানরা 'আল্লাহ'র আসনেই বসিয়ে থাকেন এবং তার উপাসনা করেন। এমন করা উচিত নয়, তা মহান আল্লাহ নিজেই কোরআনে বলেন, ‘যারা বলে যে মারইয়ামের পুত্র মাসিহই আল্লাহ; তারা তো কুফরি করেছে। অথচ মাসিহ বলেছিল, হে বনি ইসরাইল, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, যিনি আমার রব এবং তোমাদেরও রব। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। জালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই। নিশ্চয়ই তারা কাফির, যারা বলে, আল্লাহ তিনের এক; অথচ এক উপাস্য ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। যদি তারা তাদের উক্তি থেকে নিবৃত্ত না হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যারা কুফরির ওপর অটল থাকবে, তাদের ওপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পতিত হবে।’ (সুরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৭২-৭৩)
হযরত ঈসা (আ.) এর উপর ইঞ্জিল শরিফ নাজিল হয়। কিন্তু বর্তমানে প্রকৃত ইঞ্জিলের কোনো অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে ইঞ্জিল বলতে মথি, মার্ক, লুক ও ইউহান্না এই চারজনের সংকলিত ঈসা (আ.) এর চারটি জীবনীগ্রন্থকে বোঝায়। এর সঙ্গে লুকের লেখা ‘প্রেরিত পুস্তক’, পৌলের লেখা ১৪ চিঠি এবং পিতর ইউহান্না প্রমুখের লেখা আরো আটটি পত্র ও পুস্তিকাসহ মোট ২৭টির সমষ্টিকেও ইঞ্জিল বলা হয়ে থাকে। তবে খ্রিস্টানরা সাধারণত ২৭টির সমষ্টিকেই ‘ইঞ্জিল শরিফ’ নামে প্রচার করে থাকে, যদিও এই চারটি গ্রন্থের রচয়িতা সম্পর্কে যথেষ্ট বিতর্ক আছে।
মহান আল্লাহ সম্পর্কে হযরত ঈসা (আ.) যে শিক্ষা দিতেন, তা নিরবচ্ছিন্ন সূত্রে পাওয়া না গেলে এটা পরিষ্কার যে তিনি তাঁর উম্মতকে তাওহিদ তথা একত্ববাদের শিক্ষা দিয়েছেন। বর্তমানে প্রচলিত ইউহান্নার ইঞ্জিলে আছে, ঈসা মাসিহ (আ.) মহান আল্লাহর কাছে মোনাজাত করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাকে অর্থাৎ এক ও সত্য আল্লাহকে আর তুমি যাকে পাঠিয়েছ সেই ঈসা মাসিহ (আ.) কে জানতে পারাই সত্য জীবন।’ (ইউহান্না ১৭:৩)। একজন নেতা ঈসা (আ.) কে বলেছিলেন, হুজুর! আপনি একজন ভালো লোক। ঈসা (আ.) তাঁকে বলেন, ‘আমাকে ভালো বলছেন কেন? একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউই ভালো নয়।’ (লুক ১৮ : ১৮, ১৯)। এসব বক্তব্য থেকে এই উপসংহারে পৌঁছা খুব সহজ যে ঈসা (আ.) তাঁর উম্মতকে তাওহিদ তথা একত্ববাদের শিক্ষা দিয়েছেন।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, 'আর তাদের এ কথা বলার কারণে যে আমরা মারইয়াম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি, যিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুল। অথচ তারা না তাকে হত্যা করেছে, আর না শূলীতে চড়িয়েছে, বরং তারা এক রকম ধাঁধায় পতিত হয়েছিল। বস্তুত তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এ ক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধু অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোনো খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তারা তাকে হত্যা করেনি, বরং আল্লাহ তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন নিজের কাছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। ' (সুরা নিসা : ১৫৭-১৫৮)
যিশুখ্রিস্ট বা হযরত ঈসা (আ.) খ্রীস্টধর্মের মত ইসলাম ধর্মেও তিনি সম্মানিত একজন নবী; তবে ইসলাম ধর্মে তার ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে স্বীকার ও বিশ্বাস করা হয় না। বলা হয় যে, ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য যখন বাহক তাকে নিতে ঘরে প্রবেশ করে তখনই আল্লাহ তাকে উপরে তুলে নেন এবং বাহকের চেহারাকে ঈসা (আ.) এর চেহারার অনুরুপ করে দেন; ফলে ঈসা মনে করে ঐ বাহককে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। ইসলাম ধর্ম মতে, হযরত ঈসা (আ.) বর্তমানে জীবিত অবস্থায় জান্নাতে অবস্থান করছেন। কেয়ামতের পূর্বে মসীহ দাজ্জালের আবির্ভাবের পর হযরত ঈসা (আ.) শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর একজন উম্মত বা অনুসারী হিসেবে পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। এরপর সমস্ত পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করবেন এবং পৃথিবীতে শান্তি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। পৃথিবী তখন ফুলে, ফসলে নতুন এক জান্নাতের রূপ ধারণ করবে। সকলে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে। সবশেষে তিনি একজন রাজা হিসেবে মৃত্যূবরণ করবেন এবং মুহাম্মদ (স.) এর কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট।
আমার বার্তা/জেএইচ