ঘড়ির কাঁটা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে পেরোতে থাকে সময়। সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টার হিসাব রূপান্তরিত হয় দিন-মাস-বছরে। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শেষ হলো আরও একটি বছর। যত দিন যাচ্ছে অশান্ত হয়ে উঠেছে পৃথিবী। মানুষ প্রকৃতির শত্রু হয়ে উঠছে। মানুষের লোভ ও লালসা মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালে যেমন প্রকৃতির রোষের মুখে পড়তে হয়েছে বিশ্বকে, তেমনই ক্ষমতা ও দম্ভের মোহে মানুষের ওপর হামলা চালিয়েছে মানুষই।সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধের বিষবাষ্প, ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে মানুষই আজ মানুষের বড় শত্রু। দেশে দেশে সংঘাতে জারি মৃত্যুর মিছিল। যুদ্ধের বলি নিষ্পাপ শিশুরাও।কোথাও আবার সরকারের বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থান নাড়িয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত। এমনই দুনিয়া কাঁপানো বিভিন্ন ঘটনা উপহার দিয়েই বিদায় নিল ২০২৪। বছরের শুরুতেই বিভিন্ন দেশ যখন বর্ষবরণের আনন্দে মেতে ওঠে সেসময়ই প্রকৃতির রুদ্ররোষে পড়ে জাপান। বছরের প্রথম দিনেই ৭.৬ মাত্রার তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে উদীয়মান সূর্যের দেশ। আঘাত হানে সুনামিও। প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ, ক্ষয়ক্ষতিও হয় বিস্তর।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লাক্ষাদ্বীপ সফরের পরেই মালদ্বীপ-ভারত সংঘাত তুঙ্গে ওঠে। মোদিকে নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করেন দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুর দলের একাধিক নেতা। এমনকী ভারতের সমুদ্র সৈকতগুলো নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত বলেও কটাক্ষ করেন সেদেশের কয়েকজন নেতা। তারপরই নিন্দার ঝড় ওঠে। গোটা ভারত জুড়ে শুরু হয় বয়কট মালদ্বীপ। তাছাড়া বিশ্বে খাদ্যসঙ্কট, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি বিষয় ২০২৪ সালকে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের জন্য চ্যালেঞ্জপূর্ণ করে তুলেছে।
আর্থিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) সতর্ক করে বলেছে, ঋণগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য ১৯৯৬ সালে তারা এইচআইপিসি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, তা এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারণ এ উদ্যোগের মাধ্যমে সাহায্য করার জন্য প্রচণ্ড ভাবে ঋণগ্রস্ত দরিদ্র ৩৯টি উন্নয়নশীল দেশকে চিহ্নিত করেছিল, যেখানে উচ্চ মাত্রার দারিদ্র্য রয়েছে এবং ঋণের মাত্রাও বেশি। মূলত বিদেশী ঋণের পরিমাণকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসার জন্য এসব দেশকে সহায়তা করা হতো। কিন্তু বর্তমান চলমান পরিস্থিতিতে মধ্যম আয়ের অনেক দেশও ঋণের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। যেমন এইচআইপিসি উদ্যোগের মধ্যে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার নাম ছিল না। কিন্তু তারা এখন প্রচণ্ডভাবে বৈদেশিক ঋণের চাপে জর্জরিত। এমনকি ২০২২ সালের নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এমন দেশগুলোতে ১০ হাজার কোটি ডলার সহায়তা দেয়ার কথা প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনটির দিকে সবার চোখ ছিল।আশা করা হয়েছিল, সেখানে সবচেয়ে বেশি চাপে থাকা দেশগুলোকে সহায়তা করার ব্যাপারে একটি পরিকাঠামো তৈরি করা হবে। কিন্ত তাও যেন আশায় গুড়েবালি।এদিকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে নির্বাচন ভোট বয়কট করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে আমেরিকা। কিন্তু সমস্ত কিছু নস্যাৎ করে বিপুল জনসমর্থন পান হাসিনা। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ফের সরকার গঠন করে তাঁর দল আওয়ামী লীগ।১০ জানুয়ারি টানা চতুর্থবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। কিন্ত নির্বাচন জেতার আট মাসের মধ্যেই গদিচ্যুত হন শেখ হাসিনা।
৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-জনতার গণ অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।এরপর ৮ আগস্ট বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট হন লাই চিং তে ওরফে উইলিয়াম লাই। তার এই জয়ে অস্বস্তি বাড়ে চিনের। বরাবরই অভিযোগ ছিল, এই নির্বাচনে কলকাঠি নাড়ছে বেজিং। তাইপেইতে নিজের পছন্দের প্রেসিডেন্ট চেয়েছিল কমিউনিস্ট দেশটি। আর সেই কারণেই লাইকে বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে প্রচার চালিয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত শেষ হাসি হাসেন শাসক ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির নেতাই। এর আগে তিনিই ছিলেন তাইওয়ানের ভাইস প্রেসিডেন্ট। আট ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। জেলে বসেই আমজনতার জন্য বিশেষ বার্তা দেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ভোটের ফল গণনার পর দেখা যায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, শাহবাজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)। সবচেয়ে বেশি আসনে জয় পান ইমরানের দল পিটিআই সমর্থিত দল। কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার কারণে তারা সরকার গঠন করতে পারেননি। ফলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন শেহবাজ শরিফ। এই ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। সীমান্ত পেরিয়ে বাঁধভাঙা জলের মতো ঢুকে পড়ে রুশ সেনারা। দুই প্রাক্তন সোভিয়েত সদস্যভুক্ত দেশের মধ্যে শুরু হয় প্রবল যুদ্ধ। কিন্তু এখনও কিয়েভ দখল করতে পারেনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। লড়াইয়ে কয়েক হাজার সেনা ও বিপুল অস্ত্র খুইয়েছে মস্কো। দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করে ভাঁড়ারে টান পড়েছে ইউক্রেনেরও। কিন্তু থামেনি সংঘাত।
এভাবেই যুদ্ধের দুবছর পূর্ণ করেছে দুপক্ষ। একের পর এক বিপুল অঙ্কের সামরিক প্যাকেজ ঘোষণা করে বন্ধু কিয়েভের পাশে রয়েছে আমেরিকা। ১৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রথম শত্রু অ্যালেক্সেই নাভালনির। রাশিয়ার ফেডারেল জেল বিবৃতি জারি করে জানায়, হাঁটতে বেরিয়েছিলেন নাভালনি। তখনই অসুস্থতা বোধ করেন রাশিয়ার বিরোধী নেতা। খানিকক্ষণের মধ্যেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে যান তিনি। দ্রুত অ্যাম্বুল্যান্স টিম হাজির হয় ঘটনাস্থলে। সেই দলই তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করে। তারপর থেকেই সরগরম হয়ে ওঠে রাশিয়ার রাজনীতি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের খুনের অভিযোগ তোলে নাভালনির পরিবার। ১৭ মার্চ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় রাশিয়ায়। ফলপ্রকাশের পর দেখা যায় ভ্লাদিমির পুতিনের ঝুলিতে রয়েছে ৮৭.৮ শতাংশ ভোট। ফলে বিপুল জনসমর্থন পেয়ে ফের রাশিয়ার মসনদে বসেন পুতিন। টানা পঞ্চমবার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন তিনি। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্যালেস্টাইনের জঙ্গি সংগঠন হামসকে খতম করতে দক্ষিণ গাজার রাফায় ঢুকে পড়ে ইসরায়েলের ট্যাঙ্কবাহিনী। শুরু হয় অভিযান।রাফার শরণার্থী শিবিরে হামলায় প্রাণ যায় ৪৫ জনের। তারপর থেকেই সোশাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং হয় অল আইজ অন রাফা। দক্ষিণ গাজার এই শহরে অভিযান শুরু করা নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে আমেরিকার। তেল আভিভে অস্ত্রের সরবরাহে হ্রাস টানে হোয়াইট হাউস। রাষ্ট্রসংঘের তোপের মুখে পড়েন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। পাঁচ জুলাই ব্রিটেনের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়। নজির গড়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন কেয়ার স্টারমার। তাঁর দল লেবার পার্টির কাছে ভরাডুবি হয় কনজারভেটিভ পার্টির। প্রধানমন্ত্রীর গদি হারান ঋষি সুনাক। ১৪ বছর পর টোরি শাসনের অবসান ঘটে রাজার দেশে।
সাত অক্টোবর ইসরায়েলের বুকে বেনজির হামলা চালায় প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র সংগঠন হামাস। প্রাণ হারান অন্তত দেড় হাজার মানুষ। ২৫০ জনকে অপহরণ করে গাজা ভূখণ্ডে নিয়ে যায় হামাস। তারপরই অপারেশন আয়রন সোর্ড শুরু করে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স। বোমার আঘাতে কার্যত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে গাজা। এখনও পর্যন্ত গাজায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৬ হাজার প্যালেস্তিনীয়। ৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় আমেরিকায়। শুরুতে ৮২ বছরের জো বাইডেনকে প্রার্থী হিসেব বেছে নিয়েছিল ডেমোক্র্যাট। কিন্তু পরে ভোটের লড়াই থেকে সরে যান বাইডেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে শামিল হন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। কিন্তু ফলাফল প্রকাশ হতে দেখা যায় কমলাকে অনেকটা পিছনে ফেলে দিয়েছেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচন জিতে দুরন্ত প্রত্যাবর্তন ঘটান তিনি।২৭ নভেম্বর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ভয়ংকর রূপ নেয়।আল কায়দার শাখা সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নেতৃত্বে আলেপ্পো দখল করে নেওয়ার ঘোষণা করে বিদ্রোহীরা। তারপর একে দারা, হোমসের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করার পর ৮ ডিসেম্বর রাজধানী দামাস্কাসে পৌঁছায় বিদ্রোহীরা। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনীকে পিছু হঠতে বাধ্য করে তারা। পতন ঘটে আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের। এভাবেই পৃথিবীর মানুষের জীবন থেকে চলে গেল আরেকটি বছর। বিদায় নিয়েছে ঘটনাবহুল ২০২৪ সাল। যাত্রা শুরু করল ২০২৫।নানা কারণে ২০২৪ সাল মানুষের মনে দাগ কেটে রাখবে। তবে সবার নজর এখন নতুন বছরের দিকে। নতুন বছর সবার জীবনে বয়ে আনুক শান্তির বার্তা। সবার জন্য রইলো শুভকামনা।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।
আমার বার্তা/জেএইচ