”মা মা মাত কারো,ইয়ো জবান খামোশ রহেগা” ,ইত্যাদি দম্ভোক্তির মাধ্যমে পশ্চিমা শাসকরা বাঙ্গালিদের মায়ের ভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই অপচেষ্টা সফলতা লাভ করতে পারেনি।একথা স্বতঃসিদ্ব যে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধেই (২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ৭১ পর্যন্ত) বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়নি।সূর্য পুর্বদিকে উঠে পশ্চিমে অস্ত যায় এ কথায় যেমন কারো কোন দ্বিমত নেই ,তেমনি উল্লেখিত মন্তব্যটিতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।যারা এ নমাসকে পুঁজি করে এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শীর্ষস্থান দখল করতে চায় তারা ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে দেখেনা অথবা সত্যের কষাঘাতে আহত হবার ভয় পায়।ঘটনার তাৎপর্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে তারা রাজি নয়,রাজী হলে দেশের প্রগতিশীল শক্তিগুলোর অবদানকে স্বীকার করতে হয়।মুল কৃতিত্ব চলে যায় প্রতিদ্বন্দী আওয়ামীলীগের ঝুলিতে।ম্লান হয়ে যায় নিজেদের অস্তিত্ব।স্বাধীনতার স্বপ্নও দেখার সৌভাগ্য তাদের হয়নি।চাঁদও জোনাকীর ব্যাবধানে তারা নাখোশ ঈর্ষাপরায়ণ।বস্তুত এই নমাস ছিল সুদীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ফসল তোলার মৌসুম।ক্ষেত্র প্রস্তুত ,বীজ বপন,আগাছা উৎপাটনও লালন পালনে এদেশের প্রগতিশীল শক্তিগুলোকে দীর্ঘ সময় ও কঠিন শ্রম দিতে হয়েছে,মাশুল দিতে হয়েছে নজিরবিহীন,হারাম করতে হয়েছে ব্যক্তি আরাম আয়েশ।অথচ তাদের কথা আজ এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে বেমালুম।
১৯৭৪ সালের ১৪ আগষ্টের সান্তনা সর্বস্ব স্বাধীনতায় এ দেশের প্রায় সব মানুষই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।কিন্তু তারা বুঝেনি যে মুরগিটি শেয়ালের হাত থেকে গেরস্তের হাতে পরে গেলো।অর্থাৎ ইংরেজদের হাত থেকে রক্ষা পাবার একটা সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তথা কথিত ভ্রাতৃতুল্য পাকিস্থানীদের হাত থেকে রক্ষা পাবার আর কোন সম্ভাবনা রইলনা।পশ্চিম পাকিস্থানীরা এদেশের মানুষকে অভিন্ন বা তাদের সমযোগ্যতা সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে কোনদিন মেনে নেয়নি।স্বাধীনতার সূচনা থেকেই তারা ভ্রান্তনীতি অবলম্বন করতে থাকে,লিপ্ত হয় বাঙ্গালীদেরকে পদানত করার চক্রান্তে।বিষ্ময়কর এই যে জিন্নাহ থেকে আইয়ুব,ইয়াহিয়া পর্যন্ত একটি স্বপ্নের নীড়,বাঙ্গালি পরিচয় দিয়ে যিনি গর্বিত তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।
গোজামিলের পাকিস্থান পেয়ে যারা তুষ্ট হতে পারেনি (বাঙ্গালিরা) তারা পাক শাসকদের নির্বুদ্ধিতা ও ভ্রান্ত নীতিকে সম্বল করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেন।যারা তুষ্ট হয়েছিল তাদের একটি অংশ ছিল নির্বোধ এবং আরেকটি অংশ ছিল অবুঝ।পরবর্তীতে এ নির্বোধ অংশটিই নির্মমভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধীতা করে।এরাই হচ্ছে রাজাকার,আলবদর, আলসামস্ এবং আজো তারা সংশোধন হয়নি।পাকিস্থান প্রীতি স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছে তাদের মগজবিহীন মাথায়।তারা নির্মুল করতে চায় মুক্তিযুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত ভাষাভিত্তিক,বমন করে ফেলা সে উচ্ছিষ্টই।(ধর্মভিত্তিক জাতিসত্তা )আবার তারা ভক্ষণ করতে চাইছে।অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দমন , স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশকে তারা আন্তরিকভাবে স্বীকার করেনা।মাকে যারা বিশ্বাস করেনা বা স্বীকার করেনা পিতার পরিচয়ও তাদের কাছে বাতুলতা।জারজ হতেও তারা কুন্ঠিত নয়,ধর্মভিত্তিক জাতিসত্তাই তাদের কাম্য।ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ,বাঙ্গালিদের দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করে রাখার সূচনা হয় পাকিস্থান প্রতিষ্ঠা হবার আগে থেকে।তারা বিচক্ষণই জানতো যে ,একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে হলে কৌশলে তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে হবে।স্বাভাবিকভাবেই ১৯৪৭ সালের মধ্য জুলাইয়ে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ জিয়া উদ্দিন আহমেদ উর্দুকে প্রস্তাবিত পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষনায় ডঃ শহীদুল্লাহ তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ‘পাকিস্থানের ভাষা সমস্যা’ শিরোনামে আজাদ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লেখেন, অকাট্য যুক্তি স্থাপন রাষ্ট্রভাষার প্রচলন হয় তাহলেই কেবল উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।একই সনের জুলাই মাসের চিন্তা পরিহার করেন। (ডঃ আখলাকুর রহমান কর্তৃক বর্নিত শরীর চর্চা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফেব্রুয়ারী-৭৬)
কিন্তু পাকিস্থান হবার পরেও ভাষার উপর আঘাত আক্রমণ অব্যাহত থাকে,প্রত্যাশার ব্যতিক্রম ঘটে।ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয় এদেশের বাংলা ভাষাভাষীদের।তখনই এদশের বুদ্ধিজীবি ও ছাত্র শিক্ষকরা নিশ্চিত হয়ে যান যে, এ স্বাধীনতা বাঙ্গালিদের জন্য নয়,স্বাধীনতা বাঙ্গালীদের জন্য আসেনি।
১৯৪৮ সালে জিন্নাহ ঢাকার পল্টন মাঠে এবং কার্জন হলে উর্দুকে পাকিস্থানের একমাত্র রাষট্রভাষা ঘোষনা দেন।
(Urdhu and Urdhu will be the national language of pakistan) ছাত্র সমাজ দৃঢ় কন্ঠে এর প্রতিবাদ করে।মুজিবসহ গ্রেফতার করা হয় অনেককে।প্রতিবাদ ক্রমশঃ আন্দোলনে রুপ নেয়।বিক্ষুব্দচিত্তে ধীরেনদত্ত পাকিস্থানের জাতীয় পরিষদে বাংলা ভাষাকে রাষট্রভাষা ঘোষনার দাবী জানান।কিন্তু পাক শাসকরা বাস্তবতা উপেক্ষা করে ধর্মকেই পাকিস্থানের চাবিকাটি বলে ধরে নেয়।কিন্তু ধর্মীয় বাঁধনও ছিলো একটি ভাওতা মাত্র।নইলে অভিন্ন ধর্মের সুবাদে বাঙ্গালি মুসলমানদের নুন্যতম কিছু সুযোগÑসুবিধা পাবার কথা।কিন্তু তাও তারা পায়নি।উপরন্তু দমন, পীড়ন,বঞ্চনাই তাদের প্রাপ্য হয়।
“বাঙ্গালীত্ব” বজায় রাখতে যাওয়াই যেন ক্ষমাহীন অপরাধ। একমাত্র এ কারণেই পাকিস্থানীরা লক্ষ্যে দু ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।একটির নাম পূর্ব বাংলা আরেকটি আবাঙ্গালী পাকিস্থান।এ বিভাজনের জন্যে পাকিস্থানের ভুল নেতৃত্বই এককভাবে দায়ী এবং এ ফাঁকেই “ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা ”এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ দৃঢ়তর হতে থাকে।অটুট হয়ে উঠে বাঙ্গালীদের ঐক্যের বন্ধন।পাক শাসকরা তখন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ফাটল ধরাতে সচেষ্ট হয়ে উঠে এক ঐক্যের বন্ধনে।কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যায় তাদের সমস্ত অপচেষ্টা।উপায়ন্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী তারা নির্বিচারে গুলি চালায়।রফিক, সালাম, বরকরত, জব্বারের রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। সে রক্তের দুর্বার বন্ধনে আবদ্ধ হয় গোটা বাঙ্গালী জাতি।দানা বেঁধে উঠে চাপা উত্তেজনা।১৯৫৬ সালে কলকাতায় কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে কুমার মৈত্র পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা দাবী উত্থাপন করেন।দাবীটি নাকচ হয়ে গেলেও স্বাধীনতার আবহ তৈরিতে সহায়ক হয়।
শহীদ দিবসের চেতনায় ১৯৫৮ সালে আওয়ামীলীগ ও কমিওনিষ্ট পার্টির স্থানীয় নেতাদের নিয়ে ময়মনসিংহে “ইষ্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি” নামে একটি গোপন দল গঠিত হয।এ দলের প্রতি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সমর্থন ছিলো। কিন্তু সরকারী ধরপাকড়ে শেষ পর্যন্ত এ দলের কর্মকান্ড স্তব্ধ হয়ে যায়। ১৯৬১ সালে আওয়ামীলীগ ও কমিওনিষ্ট পার্টির মধ্যে ঢাকায় এক গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।বৈঠকে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবী জানান। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী সাহেব দাবীটি সরাসরি নাকচ করে দেন। মুজিব এতে ক্ষুদ্ধ হলেও তা প্রকাশ না করে সুদূর প্রসারী কর্মসূচী হাতে নেন যাকে তিনি পরবর্তিতে “নীল নকশা”বলে অভিহিত করেন।
প্রথমে তিনি আওয়ামীলীগ ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করতে থাকেন। এটাকে তিনি “প্রশিক্ষণ” বলেও উল্লেখ করেন। এরপর তিনি সাধারণ জনগনকে (বাঙ্গালী)অধিকার সচেতন করে তুলতে থাকেন।ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে থাকেন পাক শাসকের অত্যাচার অবিচার বৈষম্যের ক্ষেত্র প্রস্তুতের পূর্ব পর্যন্ত তিনি প্রকাশ্যে আর স্বাধীনতার কথা উচ্চারন করেননি। তার লক্ষ্য ছিল পাক সরকারের অনমনীয়তা এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জনগনের মুখ থেকেই স্বাধীনতার দাবী বের করা এবং হয়েছেও তাই। পাকিস্থানীরাও নির্বোধের মতো মুজিবের পাতা ফাঁদে পা রাখেন অবলীলা ক্রমে।
বাঙ্গালীদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠে পাকিস্থানী শাসন তবু তাদের বোধোদয় হয়না। অব্যাহত থাকে তাদের ষ্টীম রোলার। এমনই এক উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে মুজিব তরুপের শেষ তাসটি ব্যবহার করেন। পেশ করেন ছয়দফা দাবীনামা যা মেনে নিলেও পাকিস্থানীদের মাতব্বরী শেষ ,মেনে না নিলেও শেষ। দিশেহারা হয়ে তারা মুজিবকে ১নং আসামী করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে বসে। মামলা দায়ের করে তারা আরো বিপাকে পরে যায়। অর্থাৎ নির্যাতনের মাত্রা যতই বাড়তে থাকে বাঙ্গালীরাও ততই ঐক্যবদ্ধ এবং দুর্বার দুর্জয় হয়ে উঠে।চাপের মুখে মামলা প্রত্যাহার করতে হয়। নিঃশর্তে মুক্তি দিতে হয় মুজিবকে ,মসনদ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয় আইয়ুবকে।আসে আরেক জেনারেল ইয়াহিয়া খান।তিনি বাধ্য হন সাধারণ নির্বাচন দিতে। আওয়ামীলীগ ছয়দফার ভিত্তিতে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু তারপরেও আওয়ামীলীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়না। ব্যর্থ হয় সমঝোতার সমস্ত প্রচেষ্টা। পূর্ব বাংলার উপর থেকে উঠে যায় পাকিস্থানীদের সমস্ত নিয়ন্ত্রন ।কার্যতঃ বঙ্গবন্ধুই তখন গদিবিহীন রাষ্ট্রনায়ক ও সরকার প্রধান। ছ’দফা নিয়ে মুজিবের সাথে ইয়াহিয়ার সংলাপের অভিনয় হয়। একাত্তুরের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাক সেনা কুকুর গুলোকে লেলিয়ে দেয় নিরস্ত্র নিরপরাধ বাঙ্গালীদের উপর।ঢাকা থেকে পালিয়ে যায় ইয়াহিয়া। পাক দস্যুরা শুরু করে হত্যা ,ধর্ষণ,অগ্নিসংযোগ, লুট। যুদ্ধ চলে ন’মাস। ভারত আমাদের সক্রিয় সহযোগিতায় এগিয়ে আসে,নির্দিধায়। সহায়ক হয় সোভিযেত ইউনিয়ন।তবু বাঙ্গালী জাতিকে মাশুল দিতে হয় নির্মম। আজ ইসলাম প্রীতিতে যারা কখনো গদগদ কখনো খুনী খোমেনী, কখনো শহীদ Ñতারাই সেদিন ইসলামের নামে নারী ধর্ষণ, হত্যা ও লুটতরাজকে জায়েজ করে নিয়েছিল। কিন্তু এদেশের বীর বাঙ্গালী তা সুদৃঢ় হাতে প্রতিহত করেছিল ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা। আত্মসমর্পন করতে হয় হানাদার দস্যূ বাহিনীকে(১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১)। অথচ আজ আবিষ্কার হয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। ধিক ধিক ধিক। তবু এ বিশ্লেষণ থেকে নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হয় যে ,ভাষা আন্দোলনই স্বাধীনতার উৎস, বাঙ্গালীত্ব বজায় রাখতে গিয়েই স্বাধীনতার উদ্ভব।অর্থাৎ এদেশে স্বাধীনতার উৎস ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছে। তাইতো ভাষা আন্দোলনে বীর শহীদ সালাম,রফিক, সফিক, জব্বার, বরকতের ঋণ এ জাতি কখনো শোধ করতে পারবেনা। আমরা কখনো তাদের ভুলবোনা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে বাংলা ভাষা আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা হিসাবে জাতিসংঘে তথা বিশ্বের দরবারে স্থান পেয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে বাঙ্গালী জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবজনক। তাই একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সকালের সময়ও দ্যা ডেইলি বেষ্ট নিউজ, ঢাকা।
আমার বার্তা/কমল চৌধুরী/এমই