আছিয়া ছিল এক নিষ্পাপ কিশোরী, যার স্বপ্ন ছিল শিক্ষিত হয়ে সমাজে কিছু অবদান রাখবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন অকালেই ঝরে গেল নৃশংস ধর্ষকদের হাতে। সমাজের নিরাপত্তাহীনতা, ন্যায়বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা এবং মানবতার অবক্ষয়ের শিকার হয়ে আছিয়া এক নির্মম মৃত্যুবরণ করল। ধর্ষণের শিকার হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেও শেষ পর্যন্ত হার মানতে হলো তাকে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই নির্মমতার শেষ কোথায়? আমাদের সমাজ কি শুধুই শোক প্রকাশ করে আরেকটি নিরীহ প্রাণের বিদায় দেখবে? নাকি অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হলে অন্যরা এ ধরনের অপরাধ করতে সাহস পাবে না। পাশাপাশি, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নৈতিক শিক্ষা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। আছিয়ার মৃত্যু আমাদের জন্য একটি কঠিন বাস্তবতা ও দায়বদ্ধতার বার্তা বহন করে। এখনই সময় একত্রিত হয়ে ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এবং ধর্ষণমুক্ত সমাজ গঠনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার। আর একটি আছিয়াও যেন এমন নির্মম পরিণতির শিকার না হয়!
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের শাস্তি
বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, যা অপরাধের মাত্রা ও সামাজিক কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল।
১. সৌদি আরব: ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ। ইসলামী শরিয়াহ আইন অনুসারে দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়।
২. চীন: ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড। কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীকে গোপনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
৩. ভারত: ধর্ষণের শাস্তি ২০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ২০১২ সালের নির্ভয়া কাণ্ডের পর দলবদ্ধ ধর্ষণের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যোগ করা হয়েছে।
৪. যুক্তরাষ্ট্র: ধর্ষণের শাস্তি বিভিন্ন রাজ্যে ২০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিছু ক্ষেত্রে রাসায়নিক নপুংসককরণ (Chemical Castration) করা হয়।
৫. ইরান: ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসি, শিরশ্ছেদ বা বেত্রাঘাত। কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীকে জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে ধর্ষণের শাস্তির বিধান
বাংলাদেশে ধর্ষণের শাস্তি কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক করার জন্য বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০২০) অনুযায়ী ধর্ষণের শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে।
১. ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি: ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হতে পারে।
২. দলবদ্ধ ধর্ষণের শাস্তি: দলবদ্ধ ধর্ষণের ক্ষেত্রে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
৩. ধর্ষণের ফলে মৃত্যু হলে: ভুক্তভোগীর মৃত্যু হলে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
৪. ধর্ষণচেষ্টার শাস্তি: ধর্ষণচেষ্টা করলে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
৫. দ্রুত বিচার ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল: ধর্ষণের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে।
আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা বাড়ালে ধর্ষণের ঘটনা কমানো সম্ভব। তবে, শুধু শাস্তি প্রদান নয়, নারীর নিরাপত্তা, জনসচেতনতা ও নৈতিক শিক্ষার প্রসার ধর্ষণমুক্ত সমাজ গঠনে সহায়ক হতে পারে।
ধর্ষণমুক্ত সমাজ: আমাদের করণীয় কী?
ধর্ষণ একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি, যা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য একটি কলঙ্ক। প্রতিনিয়ত নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে। সমাজে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে, যার ফলে নারীরা স্বাধীনভাবে চলাচল ও কাজ করতে ভয় পাচ্ছে। ধর্ষণমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য আমাদের একত্রিত হয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
ধর্ষণ একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি, যা নারীর নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ। এটি শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ধর্ষণমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা জরুরি। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে সমাজে ভয় সৃষ্টি হবে। পরিবার, স্কুল, কলেজ ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে নারীর প্রতি সম্মানবোধ তৈরি করতে হবে। গণপরিবহন ও জনসমাগমস্থলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে এবং হেল্পলাইন সুবিধা সহজলভ্য করতে হবে। পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষা শুরু করতে হবে, যাতে ছেলে-মেয়েরা নারীর মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়। সার্বিকভাবে, সরকার, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ধর্ষণমুক্ত সমাজ গঠন করা সম্ভব। এখনই আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ সমাজে বেড়ে উঠতে পারে।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
আমার বার্তা/জেএইচ