অতিরিক্ত ভাড়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেও মাঠ পর্যায়ে কোনো সুফল মেলেনি। উল্টো বেশি ভাড়া আদায়ের মহোৎসব চলছে। যদিও মোটরমালিক এসোসিয়েশন বা পরিবহন মালিকরা বিষয়টি তাদের নজরে নেই বলে দাবি করে আসছেন। আবার কেউ কোনো অভিযোগ দেননি বলেও তারা বলছেন। এদিকে বিভিন্ন বাস টার্মিনালে বর্ধিত ভাড়া আদায়ের দৃশ্য চোখে পড়লেও প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে বেশি ভাড়া আদায়ের কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
ঈদকে ঘিরে বর্ধিত ভাড়ার বিষয়ে বেশ আগেই পরিবহন মালিক সমিতি এক ফরমান জারি করে। যেখানে বলা হয় কেউ যদি বেশি ভাড়া আদায় করেন বা কারও বিরুদ্ধে যাত্রী হয়রানির অভিযোগ ওঠে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এসব কঠোর ব্যবস্থার ভিতরে উল্লেখ করা হয় তাদের রুট লাইসেন্স বাতিল করা হবে। এমনকি যেসব শ্রমিক এহেন কাজে জড়িত থাকবেন সমিতি তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ নেবে। যদিও এসবই আইওয়াশ বলে তখনই দাবি করেছিলেন যাত্রীরা।
কারণ, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানতেন এসবই বজ্র আটুনি ফস্কা গিরো। কারণ, বর্ধিত ভাড়া যেমন পরিবহন মালিক শ্রমিক ভোগ করে থাকেন তেমনি একটি বড় অংশ যায় প্রশাসনের পকেটে। এমনকি সরকারি দলের নেতা-নেত্রীরাও তার ভাগ পান। তাই এমন বাণী কোনভাবেই কার্যকর করার মতো সাধ্য কারো নেই। যদিও এ বিষয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য এক ধরনের অভিযোগ বাক্স রাখা আছে। গতকাল দক্ষিণ বঙ্গের বেশ কয়েকটি কাউন্টারে যেয়ে সত্যটি উৎঘাটিত হলো।
গত মঙ্গলবার সকাল থেকেই দক্ষিণবঙ্গের ব্যস্ততম টার্মিনালে যাত্রী সমাগম চোখে পড়ে। এখানে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে কর্মস্থলে ফিরছেন মানুষ। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। ফলে বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে কর্মস্থলে ফিরতে হচ্ছে যাত্রীদের।
গত সোমবার নগরীর কেন্দ্রীয় নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে নানা ভোগান্তি পেরিয়ে যারা বাড়ি এসেছিলেন, ঈদ শেষে তারাই আবার লঞ্চ ও বাসে গাদাগাদি করে এখন কর্মস্থলে ফিরছেন। এসময় যাত্রীরা অভিযোগ করেন বাস মালিকরা ৪৫০ টাকার ভাড়া এখন ৭০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন।
মোহাম্মদ হাবিবুল্লা যিনি গ্রামে এসেছিলেন ঈদ কাটাতে। ঈদের আনন্দ পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নিতে। কিন্তু আসা যাওয়ার বিড়ম্বনায় পড়ে তার সে আনন্দ একেবারেই মাটি হয়ে গেছে। নিজে কাজ করেন একটি প্রাইভেট সেক্টরে। সামান্য বেতনে তার সংসার চালাতে যেয়ে হিমসিম খেতে হয়। তারপরেও গ্রামের বাড়িতে বাবা-মা-স্ত্রী থাকায় তিনি গ্রামে এসেছেন স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। আর সেখানেই পড়েছেন বিড়ম্বনায়। কিন্তু আসা থেকেই শিকার হন বিড়ম্বনার। ঢাকা থেকেই তাকে অতিরিক্ত টাকায় টিকিট কিনতে হয়। তখন হাত ক্যাশ মোটামুটি থাকায় খুব একটা দুশ্চিন্তা আসেনি। কিন্তু ফেরার বেলায় তিনি পড়েছেন দারুণ বিপাকে। হাতের সঞ্চয় কমে আসায় তিনি ভাড়া নিয়ে দরকষাকষি করতে বাধ্য হন। কিন্তু সব পরিবহন কাউন্টারে একই কথা। ৫০০ টাকার টিকিট ৭০০ টাকা।
যাত্রী হাসনাদ কবীর জানান, বরিশাল থেকে গোল্ডেন লাইন পরিবহনে ঢাকা পর্যন্ত অন্য সময়ে ৫০০ টাকা টিকিট হলেও এখন ৭০০ টাকা নিয়েছে। কয়েকটি বাস কাউন্টার ঘুরে একই চিত্র দেখা গেছে, ফলে বাধ্য হয়ে বেশি ভাড়া দিয়েই যেতে হচ্ছে। এভাবেই বেশি ভাড়া গুণে কর্মক্ষেত্রে আসতে বাধ্য হয়েছেন স্বপন মৃধা, শাওন মল্লিক শাকিল আহমদসহ শত শত যাত্রী। তাদের একই অভিযোগ সরকার এবং পরিবহন কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের সঙ্গে মশকরা করেছেন।
তবে বেশি ভাড়া নিয়েই কিন্তু বিড়ম্বনার শেষ হচ্ছে না। পরিবহন কর্তৃপক্ষ অন্যান্য সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত ভাড়াতো নিচ্ছেই পাশাপাশি চলতি পথে ইচ্ছেমতো গাড়িতে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠাচ্ছে। এজন্য বাসের অভ্যন্তরে মোড়ার প্রচলন করেছে। বরিশাল থেকে ঢাকা পুরো পথেই এমন ঘটনা ঘটে। এ রুটে প্রশাসনের কোনো নজরদারি চোখে পড়ে না।
রাজিব নামের ঢাকাগামী আরেক যাত্রী বলেন, আগে ঈদের ছুটিতে লঞ্চেই বরিশাল আসা যাওয়া করা হতো। পদ্ম সেতু চালুর পর থেকে বাসেই আসা যাওয়া করি। তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টায় ঢাকা-বরিশাল আসা-যাওয়া করা যায়। কিন্তু এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে বাস সংশ্লিষ্টরা।
তবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি অসীম দেওয়ান ভিন্নমত রাখেন। তিনি বলেন, আপনি অভিযোগ করছেন কিন্তু আমরা নিয়মিত মনিটরিং করছি। সেখানে এমন ধরনের কোনো ঘটনার কথা আমরা শুনিনি। অসীম দেওয়ানের কাছে জানতে চাওয়া হয় আপনি কী মনে করেন সত্যিই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না? এর জবাব না দিয়ে তিনি বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কোনো অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া যাত্রীদের সুবিধার্থে বাস টার্মিনাল এলাকায় বুথ বসানো হয়েছে। সেখানেও কেউ অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মি. দেওয়ান বলেন, ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘব ও যানজট নিরসনে বাস মালিক গ্রুপ ও প্রশাসন নিরলসভাবে কাজ করছে। যার সুফল যাত্রীরা পাচ্ছে। মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যে কোনো যানজট ছাড়াই বাড়ি ফিরেছে, এখন কর্মস্থলে ফিরছে।
কথা হয় বরিশাল মেট্রোপলিটনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক বিভাগ) রুনা লায়লার সঙ্গে। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ যেন নিরাপদে এবং ভোগান্তি ছাড়া কর্মস্থলে ফিরতে পারে তা নিশ্চিতে বাস টার্মিনাল ও লঞ্চ ঘাট এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এছাড়া সড়কে যেন গাড়ি রেখে কেউ ভোগান্তি না তৈরি করে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া আছে। ভোগান্তিমুক্ত যাত্রার নিশ্চয়তা দিতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। যদিও তিনি অতিরিক্ত ভাড়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান নি। শুধু জানান, আমরা নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছি।
নৌপথ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তায় বন্দর কর্তৃপক্ষ সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। লঞ্চ যাতে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ছাড়তে না পারে সেজন্য জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট টিমের পাশাপাশি আমরাও সার্বিক সহায়তা করছি।
আমার বার্তা/জেএইচ