ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হয় ১৬ জুন রোববার। এর ঠিক আগের দুই দিন ১৪ ও ১৫ জুন (শুক্র ও শনিবার) ছিল সাপ্তাহিক ছুটির কারণে সচিবালয়ে কর্মরত বেশির ভাগ কর্মকর্তাই ১৪ জুন বা তার আগেই নির্ধারিত গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৫০ কোটি টাকার একটি দরপত্রের ব্যয় মঞ্জুরি দিতে শুক্র ও শনিবার কোনো কোনো কর্মকর্তাকে অফিস করতে হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব জাহাঙ্গীর আলম ঈদের আগে শুক্রবার অফিসে থেকে ব্যয় মঞ্জুরির নথি প্রস্তুত করান। পরদিন শনিবার (১৪ জুন) সেই নথি যুগ্ম সচিব সালমা সিদ্দিকা মাহাতাব স্বাক্ষরিত চিঠিতে অনুমোদনও করা হয়। সেই অনুমোদনের চিঠি রয়েছে এই প্রতিবেদকের কাছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ১৫ জুন শনিবার ওই নথি অনুমোদন করেন। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সেটি আবার স্থগিত করা হয়।
পরে সেই ৫০ কোটি টাকার দরপত্রটি ২৯ জুলাই ফের অনুমোদন দেয়া হয়। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মিজানুর রহমান তার পছন্দের ঠিকাদার কোম্পানি এরবিস ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড কে কাজ পাইয়ে দিতে চারবার (প্রকল্পের পরিচালক বর্ণিত প্যাকেজ (জিডি-৩) এর দরপত্র আহ্বান করেছেন। প্রথমবার গত ২৭-১০-২০২২ তারিখে, দ্বিতীয়বার গত ০৮-১১-২০২৩ তারিখে, তৃতীয়বার গত ০৭-০৩-২০২৪ তারিখে এবং চতুর্থবার গত ০৭-০৫-২০২৪ তারিখে) দরপত্র আহ্বান করা হয়।
তথ্য বলছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ছুটির দিনে তড়িঘড়ি করে গত ১৪ জুন ২০২৪ শুক্রবারে প্রায় ৫০ কোটির একটি দরপত্র অনুমোদন করা হয় (যাহার স্মারক নং-৪৫,০০,০০০০.১৫৭.৭০.০০২.২১-৮৩)। পরবর্তীতে উক্ত কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে চলতি বছরের গত ১৪ জুন বিষয়টি জানাজানি হয় এবং তৎপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন উক্ত কেনাকাটার স্থগিতাদেশ দেন। কিন্তু স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সুযোগ সন্ধানী একটি মহল দেশের চলমান (গত ১৭ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত) ক্রান্তিকালে গত ২৯ জুলাই সোমবারে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ দরপত্রটি (জিডি-৩) অনুমোদন ও ব্যয় মঞ্জুরি প্রদান করেন যাহার (স্মারক নং-৪৫.০০.০০০০.১৫৭.৭০.০০২.২১-৯৭)। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের জারিকৃত অনুমোদনের কপিগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ১৪-০৬-২০২৪ তারিখের জারিকৃত অনুমোদিত ব্যয় মঞ্জরিতে মোট ১১ টি শর্ত উল্লেখ রয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য শর্তের মধ্যে একটি "বর্ণিত প্যাকেজের সকল আইটেমের যথাযথ ওয়ারেন্টি/গ্যারান্টি এবং সিএমসি বিধি মোতাবেক নিশ্চিত করতে হবে" কিন্তু গত ২৯ জুলাই অনুমোদিত ব্যয় মঞ্জরিতে মোট ১০ টি শর্ত উল্লেখ রয়েছে এবং একই সাথে গত ১৪-০৬-২০২৪ তারিখের জারিকৃত (৪৫.০০.০০০০.১৫৭.৭০.০০২.২১-৮৩) সংখ্যক পত্রটি বাতিল করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন শাখার সূত্র মতে, দরপত্রের চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসা যন্ত্রগুলোর ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য যান্ত্রিক সক্ষমতা রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থে বাধ্যতামূলকভাবে সিএমসি (কমপ্রিহেনসিভ মেইনটেনেন্স কন্ট্রাক্ট) করার নির্দেশনা রয়েছে। তবে উল্লিখিত দরদাতা প্রতিষ্ঠান সিএমসি প্রস্তাব সঠিকভাবে দাখিল করেনি। এতে ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবে সরকারের আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে মর্মে উল্লেখ করেন।
সামগ্রিক বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ওয়ারেন্টি/গ্যারান্টি এবং সিএমসি (কমপ্রিহেনসিভ মেইনটেনেন্স কন্ট্রাক্ট) এর মত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত বাদ দিয়ে দেশের ক্রান্তিলগ্নে ৫০ কোটি টাকার দরপত্র অনুমোদনের বিষয়টি স্পষ্টতই দরপত্রে বিভিন্ন অনিয়ম ও চরম দুর্নীতির আলামত। এখানে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে প্রকল্প পরিচালক মিজানুর রহমান, স্বাস্থ্যের সচিব জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা সামন্ত লাল সেনসহ একটি বিশেষ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিকভাবে এই সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি নিশ্চিত করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক গতবছর ডিসেম্বর মাসে তার পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করেন। তখন তার পছন্দের দরদাতা কোম্পানির কাজ না পাওয়ায় সেটিকে আবার কোন পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। পরে জাতীয় নির্বাচনের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয় এবং দায়িত্ব দেয়া হয় ডা সামন্ত লাল সেন কে। পরবর্তীতে ওই প্রতিষ্ঠান কাজ না পাওয়ায় প্রকল্প পরিচালক মিজানুর রহমান ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব জাহাঙ্গীর আলমের যোগ সাজসে চলতি বছরের ১৪ জুন ছুটির দিনে ৫০ কোটি টাকার দরপত্র অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সেই দরপত্রটি বাতিল করে গত জুলাই মাসের ২৯ তারিখে অন্যতম একটি শর্ত প্যাকেজের ওয়ারেন্টি গ্যারান্টি এবং সিএমসি রীতি মোতাবেক নিশ্চিত না করেই ফের অনুমোদন দেয়া হয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ মোতাবেক ২০২৩ ও ২৪ অর্থবছরে প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন খাতে প্যাকেজটি জিডি-৩ এর আওতায় ৪৯ কোটি ৫২ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪৫০ টাকা ২০ পয়সায় দরপত্র অনুমোদন দেয়। কিন্তু মূল্যায়ন কমিটির ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনায় আলোচক প্যাকেজটি অন্তর্ভুক্তকরণ সাপেক্ষে ক্যারিড ওভার প্যাকেজ হিসেবে ব্যায়মঞ্জরী জ্ঞাপন করে। অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের টাকা নিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ৫০ কোটি টাকার ক্যারিট ওভার ব্যয় মঞ্জুরি হিসেবে দেখিয়ে তারা তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজটি দেয়। যেটি অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে করা হয়েছে এতে করে সরকার বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে।
বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি থেকে সরকারকে রক্ষা করার লক্ষ্যে অবিলম্বে উক্ত ব্যয় মঞ্জুরির অধীনে ক্রয়চুক্তি সম্পাদন এবং এলসি প্রক্রিয়াকরণ বাতিল করা জরুরি বলে জানান তিনি।
আমার বার্তা/এমই