ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান। তাঁর পরিবারের সদস্যরাও অনেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন। এরপর ৫ আগষ্ট রাতে শাজাহান খানকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি দুই দফায় নৌপরিবহন মন্ত্রী থাকা অবস্থায় অপ্রতিরোধ্য ছিলেন। তবে এখনো গ্রেপ্তার হয়নি সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি ছিলেন বিআইডব্লিউটিএ'র গড ফাদার। তাদের দোসররা নতুন রূপে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার প্রয়াস চালাচ্ছেন বিআইডব্লিউটিএ'তে । এসব লোকজন চাকরিতে বহাল থেকে সঙ্গবদ্ধ হয়ে আওয়ামী শ্রমিক লীগের নামে বিআইডব্লিউটিএ'র সর্বস্তরে অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন। তাদের সাথে যোগ হয়েছেন কিছু অসাধু কর্মকর্তা। পতিত সরকার আমলে তারা ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। তাদের অনেকের নামে দুদক চেয়ারম্যানের দপ্তরে অভিযোগ থাকলেও নেয়া হচ্ছেনা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
এদিকে খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর আমলে বিআইডব্লিউটিএ’র প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা হয়েছে বলে সুনিদিষ্টভাবে খবর জানা গেছে। বিষয়টি নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ ভবন জুড়ে ইতোমধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এর সাথে জড়িত ব্যক্তিরা কমিশনের বিনিময়ে এসআলম গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা গুলো জমা রাখায় সহসাই টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন বিআইডব্লিউটিএ’র সাধারন কর্মচারীরা। এর আগে গত কোরবানীর ঈদে কর্মচারীরা বেতন-বোনাস পেতে অনেকটাই খড়কুটো পোহান। রাষ্ট্রীয় সংস্থার ৭০% টাকা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে গচ্ছিত রাখার সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। বাকী ৩০% টাকা এ গ্রেডের বেসরকারী ব্যাংকে গচ্ছিত রাখার নিয়ম থাকলেও বিআইডব্লিউটিএ অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা পারস্পরিক যোগসাজশে ৫ পয়েন্ট থেকে ১ পয়েন্ট আর্থিক সুবিধা গ্রহনের বিনিময়ে তৃত্বীয় গ্রেডের এস আলম গ্রুপের ফাষ্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক সহ ইত্যাদি ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রেখেছেন বলে বিভিন্ন সুত্র নিশ্চিত করেছে। এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংক সমুহ ইতোমধ্যে দেউলিয়ার পথে। একারনে বিআইডব্লিউটিএ’র প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা উত্তোরন হবার সম্ভবনা খুবই কম। বিআইডব্লিউটিএ’র পেনশন ভুক্ত কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাদের পেনশনের টাকা পেতে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। এছাড়া জিপিএফ লোন, গৃহনির্মান লোনও প্রদান করতে পারছেনা সংস্থাটি। এ ব্যাপারে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মামুন হোসেন এর সাথে জানতে চাওয়া হলে তিনি চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলতে পরামর্শ দেন। বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তা কর্মচারীরা পেনশন ও গৃহনির্মান ঋনের টাকা না পেলেও অর্থ বিভাগের পরিচালক গোপাল চন্দ্র এবং অতিরিক্ত পরিচালক মামুন হোসেন সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের সকল কর্মকর্তাই আছেন ফুরফুরে মেজাজে। অতিরিক্ত পরিচালক মামুন হোসেন এর ঢাকায় একাধিক বাড়ি গাড়ির সন্ধান মিলেছে । রাজধানীর সবুজবাগ থানাধীন বাসাবোতে ছয়তলা আলীশান বাড়িও করেছেন তিনি। বিআইডব্লিউটিএ’র দূর্নীতিবাজদের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান অব্যহত।
কে এই শাজাহান খান? - জাসদের রাজনীতি ছেড়ে আওয়ামীলীগে আসেন শাজাহান খান। শ্রমিকনেতা হিসেবে পরিচিত শাজাহান খান বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। টানা আটবারের এই সংসদ সদস্য (এমপি) দুই মেয়াদে নৌপরিবহনমন্ত্রী ছিলেন। তিনি মাদারীপুরে পরিবহন সেক্টর এবং বিআইডব্লিউটিএ’তে প্রতিষ্ঠা করেছেন ব্যক্তিগত ক্যাডার বাহিনী। তাঁদের দাপটে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ছিলেন অতিষ্ঠ। ভাই ও স্বজনদের মাধ্যমে মাদারীপুর জেলার প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছিল তাঁর একক আধিপত্য। জমি দখল, কমিশন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। দুই দফায় নৌপরিবহনমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। নিজস্ব বলয়ে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি দিয়েছেন শত শত লোকজনকে।
শাজাহান খান মাদারীপুর-২ (সদর-রাজৈর) আসনের সাবেক এমপি। মাদারীপুরে তাঁর বিকল্প কেউ নেই বলে মনে করতেন তাঁর পরিবার। খান পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে সদর ও রাজৈরে কোনো কাজ হতো না। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের বাড়িও মাদারীপুর শহরে। আওয়ামী লীগের শাসনামলের পুরোটা এই দুই কেন্দ্রীয় নেতার দ্বন্দ্ব জাতীয়ভাবেও আলোচিত। পরিবহন শ্রমিকনেতা হিসেবে বিগত আওয়ামীলীগের সাড়ে ১৫ বছরে এই খাতের চাঁদার অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন শাজাহান খান। তাঁদের দাপটে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ছিলেন অতিষ্ঠ। বিআইডব্লিউটিএ ঘিরে এখনো চলছে শাজাহান খান বাহিনীর তান্ডব। অনেক কর্মকর্তাকে তারা জিম্মি করে নিজের অস্তিত্বের বিষয়ে জানান দিচ্ছেন।
শাজাহান খান ২০১৩ সালে গড়ে তোলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চ। ২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হন। এ সময় তাঁর বিরুদ্ধে অমুক্তিযোদ্ধাদের টাকার বিনিময়ে সনদ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে। ২০১৫ সালে গড়ে তোলেন শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ। সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে তিনি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মিলে গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও প্রজন্ম সমন্বয় পরিষদ। একাংশের চাঁদা উঠানোর দায়িত্ব দেয়া হয় বিআইডব্লিউটিএ'র শ্রমিক লীগ নেতা আখতার, সারোয়ার, আবুল, মজিবুর, রফিক গংদের।
নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামা অনুযায়ী, ১৫ বছরে শাজাহান খানের আয় বেড়েছে ৩২ গুণ। শাজাহান খানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সার্বিক কনস্ট্রাকশন, সার্বিক শিপিং লাইন চট্টগ্রাম, সার্বিক ইন্টারন্যাশনাল হোটেল, সার্বিক পেট্টোলপাম্প সবকিছুই তাঁর স্বজনদের নামে। মাদারীপুর-ঢাকা ও ঢাকা-বরিশাল সড়কপথে আধিপত্য বিস্তারকারী সার্বিক পরিবহন তাঁর মালিকানাধীন। সার্বিক পরিবহনের নামে বর্তমানে দুই শতাধিক গাড়ি চলাচল করছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাঁর ছেলে আসিবুর রহমান খান।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পরপরই আত্মগোপনে চলে যান শাজাহান খান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। ৫ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে শাজাহান খানকে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর থেকে তাঁর ছেলে আসিবুর রহমান খানকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপরও তাঁদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেননা বিআইডব্লিউটিএ'র সাধারণ কর্মচারী এবং এলাকাবাসী। বিআইডব্লিউটিএ সহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছিল তাঁর একক আধিপত্য। জমি দখল, কমিশন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
শাহাজাহান খানের ১৯৬৪ সালে ছাত্ররাজনীতি দিয়ে হাতেখড়ি। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে মাদারীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হন শাজাহান খান। জাসদে যোগ দিয়ে জেলা জাসদের যুগ্ম আহ্বায়ক হন। ১৯৮৬ সালে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে প্রথমবারের মতো এমপি হন। ১৯৯১ সালে জাসদ ছেড়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হন। এরপর প্রতিটি সংসদে তিনি এমপি ছিলেন। ২০০৯ থেকে টানা ১০ বছর নৌমন্ত্রী ছিলেন তিনি। এই দশ বছরে নৌ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিআইডব্লিউটিএ'র প্রতিটি সেক্টরে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলেন। বন্দর সহ সব সেক্টরে টেন্ডার বাণিজ্য করে টাকার মেশিন বনে যান তিনি। তার ভয়ে সবাই থাকতেন তটস্থ।
স্থানীয় প্রায় সব নির্বাচনে পরিবারের বাইরে কাউকে সুযোগ না দেয়ায় দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শাজাহান খানের দূরত্ব বাড়ে। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলেও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তাঁর পক্ষে প্রচারে নামেননি।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কয়েক ঘন্টা পরই শাজাহান খান ও তাঁর ভাইদের বাসভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৫ আগস্ট বিকেলে মাদারীপুর শহরের কলেজ গেটের সামনে সরকারের পতনের কয়েক ঘন্টা পরই শাজাহান খান ও তাঁর ভাইদের বাসভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। মাদারীপুরবাসির ভাষ্যমতে, ‘শাজাহান খান কখনোই আওয়ামী লীগ করেন নাই। তিনি ব্যক্তি-লীগ করেছেন। তিনি একক ক্ষমতার অপব্যবহার করে দমন-নিপীড়ন করেছেন; যা নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে বহু বছর ধরেই বিভেদ ও দ্বন্দ্ব লেগে ছিল।’
একসময় শাজাহান খানের পুরো সিন্ডিকেট (চক্র) নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁরই চাচাতো ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দু’বারের উপজেলা চেয়ারম্যান পাভেলুর রহমান খান। তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বের পর ছোট ভাই ওবায়দুর রহমান খানকে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানান শাজাহান খান। ওবায়দুর আইনজীবী সমিতির সভাপতি হওয়ায় আদালতপাড়ায় ছিল তাঁর আধিপত্য। কেউ শাজাহান খানের বিরুদ্ধে গেলেই মামলার আসামি বানিয়ে হয়রানি করা হতো।
শাজাহান খানের আরেক ভাই হাফিজুর রহমান খান। তিনি মাদারীপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি। সবার কাছে ‘নানা’ হিসেবে পরিচিত হাফিজুর জেলার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কার্যালয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সার্বিক কনস্ট্রাকশনের প্রধান। জেলার ৮০ ভাগ উন্নয়নকাজ ওই প্রতিষ্ঠান পেত। অন্য ঠিকাদারদের কাছে কমিশনের মাধ্যমে কাজ বিক্রি করে দিতেন তিনি। পাসপোর্ট কার্যালয়, বিআরটিএ, সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, থানাসহ বেশ কয়েকটি কার্যালয়ে হাফিজুরের একক আধিপত্য ছিল। ওই কার্যালয়গুলোতে হাফিজুরের নিয়োগ করা লোকজনকে কমিশন না দিলে ফাইল নড়ত না। এর ব্যত্যয় ঘটলে হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো।
শাহাজাহান খানের সন্ত্রাসী বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে গত সাড়ে ১৫ বছর বিআইডব্লিউটিএ'তে ঢুকতে পারেননি বিএনপি পন্থী লোকজন। শাহাজাহান-খালিদ সিন্ডিকেটের বাইরে কোন ঠিকাদার কাজ পেতেননা। দুই প্রভাবশালী মন্ত্রীর লোকজন প্রমোশন, ঠিকাদারি, নিয়োগ, ঘাট ইজারাদার সহ সব কিছুই করতেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দমন-নিপীড়ন করতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআইডব্লিউটিএ'র কার্যালয়ের সামনের এক দোকানি বলেন, ‘এখানে যারা দালালি করত, বেশির ভাগই খান গ্রুপের লোক। তারা শাজাহান খান ও খালিদ মাহমুদ এর প্রভাব খাটিয়ে কাজ বাগিয়ে নিতেন। তাদের নিয়োজিত দালালদের প্রতিটি ফাইলে টাকা দিতে হতো। এখনো তারা সক্রিয়। সরকার পরিবর্তন হলেও তাদের দাপট কমেনি। তারা সিন্ডিকেট বাণিজ্য করছেন দেদারসে।
শাজাহান খানের চাচাতো ভাই পাভেলুর রহমান খান বলেন, ‘আমি তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করলেও তাঁর সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। শাজাহান খান যখন মন্ত্রী, তখন তাঁর সুপারিশ ছাড়া জেলায় কিছুই হতো না। স্থানীয় সরকারি চাকরিতেও তাঁর হস্তক্ষেপ ছিল।’ তিনি বলেন, শাজাহান খানের দ্বারা আওয়ামী লীগের লোকজন উপকৃত হয়নি। গত ১৫ বছরে তিনি ভাই, ছেলে ও আত্মীয়স্বজন দিয়ে সিন্ডিকেট করে সব নিয়ন্ত্রণ করতেন।
সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিজের ছেলেকে চেয়ারম্যান পদে ভোট করান এবং জয়ী করেন শাজাহান খান। পরে ছেলেকে মাদারীপুর জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতিও করেন প্রভাব খাটিয়ে। আমি তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করলেও তাঁর সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। শাজাহান খান যখন মন্ত্রী, তখন তাঁর সুপারিশ ছাড়া জেলায় কিছুই হতো না। স্থানীয় সরকারি চাকরিতেও তাঁর হস্তক্ষেপ ছিল।
মন্ত্রী থাকতে বাবা আচমত আলী খানের নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন শাজাহান খান। সংগঠনটির কোনো স্থায়ী ও অস্থায়ী কার্যালয় নেই। প্রতি বছর বড় পরিসরে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেখানে সরকারের মন্ত্রী ও শিল্পপতিদের রাখা হতো।
সংগঠন সূত্র জানায়, নৌমন্ত্রী থাকতে শাজাহান খান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু বছরে একবার ঠোঁটকাটা, তালুকাটা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিনা মূল্যে মেডিকেল ক্যাম্প ছাড়া কোনো সেবামূলক কাজই হয়নি। শাজাহান খান বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে ফাউন্ডেশনের জন্য টাকা দিতে বাধ্য করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী জানান ‘আমার প্রতিষ্ঠানের একটি বড় কাজ দেয়ার বিনিময়ে কমিশন বাবদ ওই ফাউন্ডেশনে ১০ লাখ টাকা অনুদান দিতে হয়েছে। তখন কমিশন না দিলে আমি কাজ করতে পারতাম না। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ভয় পেয়ে তখন টাকাটা দিতে হয়েছে। ওই ব্যবসায়ী আরো বলেন, বিআইডব্লিউটিএ'তে আমাকে একবারই কাজ দেয়া হয়েছে।
শাজাহান খান ১০ বছর নৌমন্ত্রী থাকাকালে মাদারীপুরের প্রায় তিন হাজার কর্মীকে বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসিসহ বিভিন্ন বিভাগে চাকরি দিয়েছেন বলে বিভিন্ন সভায় বক্তব্য দিয়েছেন। প্রতিটি চাকরির জন্য শাজাহান খান ও তাঁর ভাইয়েরা ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগ-বাণিজ্যে মূল তদারকি করতেন শাজাহান খানের তৎকালীন বিশেষ সহকারী রণজিৎ বণিক।
জানতে চাওয়া হলে রণজিৎ বণিক মিডিয়ার কাছে বলেন, শাজাহান খান মন্ত্রী থাকতে জেলার অনেক যুবক চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়া হয়নি।
জানা যায়, নৌপরিবহনমন্ত্রী থাকা অবস্থায় শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর ও স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া বেগমের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরে বিপুল কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। নৌপরিবহন মন্ত্রণলায়ের অধীন জাহাজ মেরামত ও নদী খননের ব্যবসা করতেন শাহাজাহানের বিশ্বস্থ আবদুর রশিদ। বিভিন্ন পথে চলাচলকারী জাহাজ ব্যবসাও আছে তার । কর্ণফুলী নদী দখল করে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় রশিদের মালিকানাধীন ‘ড্রাই ডক’ নির্মাণে সুযোগ দেন শাজাহান খান। কুমিল্লায় রশিদের গ্রামের বাড়িতে দাওয়াতও খান শাজাহান খান। মাসিক মোটা টাকা দিতেন রশিদ।
২০০৯ সাল থেকে পরিবহন খাতে প্রকাশ্যে যানবাহনপ্রতি ৭০ টাকা চাঁদা আদায় শুরু করা হয়। এর মধ্যে ৪০ টাকা যায় মালিক সমিতির হাতে। আর শ্রমিক ইউনিয়নের ১০ টাকা এবং ফেডারেশনের ১০ টাকা। বাকি ১০ টাকা সড়ক শৃঙ্খলায় নেয়া হতো। এর বাইরে অপ্রকাশ্য চাঁদা উঠত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সব মিলিয়ে এই খাতে বছরে চাঁদার পরিমাণ অন্তত ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। রাজনীতির বাইরে শাজাহান খানের বড় পরিচয় তিনি পরিবহন শ্রমিকনেতা। সারা দেশের শ্রমিকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি। শ্রমিকনেতা হলেও তাঁর পরিবারের মালিকানায় সার্বিক পরিবহন নামে বাসের ব্যবসা রয়েছে। পতিত সরকারের আমলে শাজাহান খান জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। এ দুই কমিটির মূল কাজ ছিল সড়কে শৃঙ্খলা আনা এবং এ খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ করা। কিন্তু তিনিই আবার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। সড়ক নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার সব দাবি আদায়ে সদা সক্রিয় থেকেছেন।
পরিবহন খাতের সূত্র বলছে, ফেডারেশন হিসেবে সরাসরি চাঁদা তোলার নিয়ম নেই। কিন্তু শাজাহান খান প্রতি যানবাহন থেকে দিনে ১০ টাকা চাঁদা তুলেছেন। এর বাইরে তাঁর ফেডারেশনের অধীন সারা দেশে ২৪৯টি শ্রমিক ইউনিয়ন আছে। তারাও প্রতি যানবাহন থেকে প্রতিদিন ১০ টাকা চাঁদা উঠিয়েছে।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, সারা দেশে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, হিউম্যান হলার, অটোরিকশাসহ নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহনের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় লাখ। প্রতিদিন শ্রমিকদের জন্য ২০ টাকা করে আদায় হলে চাঁদা ওঠে সোয়া কোটি টাকা। শ্রমিক কল্যাণে টাকা তুললেও করোনা মহামারির সময় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কোনো সহায়তা দেয়া হয়নি।
একাধিক শ্রমিকনেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চাঁদার টাকা প্রতিদিন রাতে বস্তায় ভরে মতিঝিলে ফেডারেশনের কার্যালয়ে আসত। মতিঝিলে জাতীয় স্টেডিয়ামের পূর্ব গেটের পাশে থাকা ভবনটির মালিকও শাজাহান খানের পরিবার। সেখানে তাঁর শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
বিআইডব্লিউটিএ'র ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন দপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্পের কে কোন কাজ পাবেন, সেটা ঠিক করে দিতেন শাজাহান খান। তাঁকে প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ৩ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে হতো।
বিআইডব্লিউটিএ'তে তার দোসররা ঘাপটি মেরে আছে। তারা যেকোন সময় ছোবল দিতে পারেন। সঙ্গবদ্ধ চক্র বেনামে ফেইসবুক আইডি খুলে সরকার বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে। বিশেষ করে শ্রমিক লীগের ব্যানারে তারা সক্রিয় হচ্ছেন। শাজাহান খানের দুই ছেলে ও মেয়ের নামে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ঢাকা, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সম্পদ আছে বলে জানা গেছে। খান পরিবারের ব্যবসা ব্র্যান্ডিং ‘সার্বিক’ নামে। এই নামে শাজাহান খান ও তাঁর স্বজনদের নামে হোটেল, পরিবহন, অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামা অনুযায়ী, শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় হলফনামায় তিনি আয় দেখিয়েছেন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরে তাঁর আয় বেড়েছে প্রায় ৩২ গুণ। একই সময়ে তাঁর অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে পাঁচ গুণ। হলফনামা অনুযায়ী, শাজাহান খানের দুটি গাড়ি এবং স্ত্রীর নামে ৮০ ভরি সোনা ছাড়া আর কোনো অস্থাবর সম্পদ দেখানো হয়নি। ২০০৮ সালে দুটি বাস, একটি গাড়ি ও একটি মাইক্রোবাস, ১৫ ভরি সোনাসহ প্রায় ৪১ লাখ টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছিল।
শাজাহান খান ও তাঁর স্ত্রীর বেশ কিছু কৃষি ও অকৃষিজমি আছে। প্রায় ৬ কোটি টাকার ভবন ও সমজাতীয় স্থাপনা আছে। দান সূত্রেও ফ্ল্যাট ও জমির মালিক হয়েছেন তিনি। তাঁর স্ত্রীর নামে আছে রাজউকের ১০ কাঠার প্লট ও অন্যান্য স্থাবর সম্পদ। তবে তাঁর দুই ছেলে ও মেয়ের নামে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ঢাকা, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সম্পদ আছে বলে জানা গেছে।
১৫ বছর আগে নৌমন্ত্রী হওয়ার পর ক্ষমতার দাপট দেখানো শুরু করেন শাজাহান খান। এরপর তিনি ও তাঁর স্বজনদের সম্পদ বাড়তে থাকে। মাদারীপুর পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে একাধিক বহুতল ভবন, জমি, মার্কেট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যদিও এসব সম্পদের বেশির ভাগই স্ত্রী, সন্তান ও ভাইদের নামে করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পৌর শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে হাফিজুর রহমান খানের জমি, সরকারি অর্পিত সম্পত্তি ইজারা নিয়ে করা ১৬টি দোকান ও পাটকল আছে। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে এক একর জমিতে অস্থায়ী দোকান, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে দুটি বহুতল ভবন, একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি, দুটি বাণিজ্যিক ভবন, একটি বিলাসবহুল পাঁচতলা আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ আছে। একই এলাকায় শাজাহান খানের ১০ তলা ভবন আছে। শাজাহানের আরেক ভাই ওবায়দুর রহমানের দুটি বহুতল বাড়ি আছে। থানার সামনে শাজাহানের ছোট ছেলে শামস খানের পাঁচতলা নতুন ভবন, পাশেই হাফিজুর রহমান ও খান পরিবারের যৌথ মালিকানাধীন হাসপাতাল, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে পুরান বাজারে জমি আছে। পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড চৌরাস্তা ও কুলপদ্বী এলাকায় জমি ও বাড়ি আছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, শাজাহান খানের দুই ভাই ও স্বজনদের অনেকে দেশত্যাগ করেছেন। শাজাহান খান ও তাঁর বড় ছেলে আসিবুর বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। শাজাহান খানের বিপুল সম্পদের ব্যাপারে কথা বলতে তাঁর পরিবারের দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে পরিবহন, পাম্প ও হোটেল চালু করা হয়েছে। বাসভবনগুলো থেকে পোড়া ময়লার স্তূপ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সরকার পতনের দিন বিকেলে শাজাহান খানের বিলাসবহুল ১০ তলা বাসভবনে আগুন দেয়া হয়। তখন হাফিজুর ও ওবায়দুর রহমান খানের মালিকানাধীন চারটি ভবন, দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল ও রেস্তোরাঁয় অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর আগেই শাজাহান খান ও তাঁর ভাইয়েরা আত্মগোপনে চলে যান। সম্প্রতি তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিলাসবহুল বাড়িগুলো নতুন করে মেরামতের কাজ করছেন শ্রমিকরা।
সচেতন নাগরিক কমিটির মাদারীপুরের সভাপতি খান মোহাম্মদ শহীদ বলেন, সাধারণ দৃষ্টিতেই শাজাহান খান ও তাঁর পরিবারের সম্পদ সবার চোখে দৃশ্যমান। ১৫ বছরে একজন জনপ্রতিনিধির এমন পরিবর্তনে সবাই বিস্মিত। দেশে গত ১৫ বছরে জবাবদিহি ছিল না বলে দুর্নীতি ও অনিয়ম ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন জনপ্রতিনিধিদের আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পদ জব্দের দাবি জানান তিনি। তাতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বিআইডব্লিউটিএ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন দশ হাজার কোটি টাকাঃ সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ঠিকাদার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অন্তত: দশ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। খালিদ মাহমুদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা রুজু হয়েছে। তার অধিনস্থ বিআইডব্লিউটিএ'র দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুদকের অচল মামলা গুলো এবার সচল হবে । চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান (বাধ্যতামূলক অবসর প্রাপ্ত) রিয়ার এডমিরাল সোহায়েল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সম্পর্কে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। এছাড়াও আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পেরেছেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর যত সব অপকর্মের খবর। খালিদ মাহমুদ কোথায় আছেন তা এখনো স্পষ্ট করে জানা যায়নি। বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন নাকি দেশেই আত্নগোপনে আছেন তাও স্পষ্ট নয়। তার অন্যতম সহযোগী এপিএস আবুল বাশার লাপাত্তা হয়েছেন গত তিন আগষ্ট। বাশারের ঢাকার বাসা এবং দিনাজপুরের বাড়িতে পুলিশ একাধিক বার তল্লাশি করেও তাকে পায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করেছেন নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তার হুকুম ছাড়া কোন টেন্ডার হতোনা। খালিদ মাহমুদের মর্জি অনুযায়ী তার পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতেন। আর যদি কোন কারণে ঠিকাদার কাজ না পেতেন তাহলে রি-টেন্ডার করা হতো। এরপর ঠিকাদারকে কাজের ব্যবস্থা করে দিতেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। অধিকাংশ কাজের দর কষাকষি হতো গণভবন এবং পুতুলের বাসায় বসে। সাইফ টেকের স্বত্বাধিকার রুহুল আমিন তরফদার , চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আযম, এমপি লতিফ ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরের ঠিকাদার। বন্দরে নির্ধারিত ঠিকাদারের বাইরে কোন ঠিকাদার কাজ পেতেননা। আর মাঝে মধ্যে যেসব ঠিকাদার টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ পেতেন তাদেরকে কাজ করতে দেয়া হতোনা। নানাভাবে হয়রানি করা হতো। আবার কাউকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টেন্ডার জমা দিতে বাঁধা প্রদান করা হতো। অনেক ঠিকাদার সিডিউল কিনেও ভয়ে টেন্ডার জমা দিতে আসতেননা। সাইফ টেকের মালিক রুহুল আমিন তরফদার ছিলেন খালিদ মাহমুদের সবচেয়ে কাছের ও বিশ্বস্ত। খালিদ মাহমুদের সহযোগিতায় রুহুল আমিন তরফদার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নৈকট্য লাভ করেন। রাতারাতি তিনি শেখ রাসেল ক্রিড়া চক্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ওই সময় রুহুল আমিন তরফদার খালিদ মাহমুদের মাধ্যমে রাসেল ক্রিড়া চক্রের উন্নয়ন মুলক কাজে শত কোটি টাকা অনুদান দেন। যা মিডিয়া গুলো ঢালাওভাবে প্রচার করেন। এসবই ছিলো ঠিকাদারি কাজের অংশ বিশেষ। ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া সোহায়ল ছিলেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর ডান হস্ত। কারণ সোহায়েল শেখ হাসিনার অনেক পারপাস সার্ভ করতেন। সোহায়েলকে গ্রেফতারের এটিও একটি অন্যতম বড় কারণ। তার কাছ থেকে শেখ হাসিনার অনেক গোপনীয় মিশনের খবর জানতে পেরেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রশাসনের কয়েক জনের মধ্যে সোহায়েল ছিলেন শেখ হাসিনার আরেকজন বিশ্বস্থ সৈনিক। সরকার ক্ষমতাচ্যুত না হলে সোহায়েলের নৌ বাহিনীর চীফ পদে পদোন্নতি অনেক টাই নিশ্চিত ছিলো।
ঠিকাদারি থেকে শুরু করে সর্বস্তরে খালিদের সিন্ডিকেটের সদস্যরা ছিলেন সক্রিয়। খালিদ মাহমুদের ছত্রছায়ায় এই দপ্তরের প্রতিটি সেক্টরের কর্মকর্তারা দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেন। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা ঠিকাদারি, নিয়োগ, বদলি ও টেন্ডারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করেছেন। খালিদ মাহমুদের অনুসারী আওয়ামী পন্থী ঠিকাদারের বাইরে কাউকেই কাজ দেয়া হতোনা। বড়ো কাজে এপিএস আবুল বাশারের মাধ্যমে ৫ % কমিশন দিতে হতো প্রতিমন্ত্রীকে। খালিদ মাহমুদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ১৫ বছর ধরে যেসব কর্মকর্তা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত এবং ওএসডি ছিলেন তাদের তৎপরতায় সুবিধাভোগিরা এখন অনেক টাই কোনঠাসা। ইতোমধ্যে ড্রেজিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, বন্দর সহ বিভিন্ন দপ্তরে ব্যাপক রদবদল হয়েছে।পতিত সরকার আমলে খালিদ মাহমুদ চেীধুরী আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদেরকে একের পর এক পদন্নোতি দিয়ে বিএনপি পন্থি কর্মকর্তাদের কোনঠাসা করে রেখেছিলেন।ওই সব অসাধু কর্মকর্তারা গত ১৫ বছরে বিআইডব্লিউটিএ’র রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। করেছেন গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স এবং নামে-বেনামে স্ত্রী সন্তানদের নামে পাহাড় সম-পরিমান সম্পদ। অধিকাংশ দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তাদেরও বিদেশে বাড়ি-গাড়ি আছে। তারা সরকারের কোষাগারের কোটি কোটি টাকা লোপাট করে বিদেশ পাচার করেছেন। অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা এবং অভিযোগ থাকলেও কারো বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। অভিযোগ আছে সাবেক নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গণ ভবন থেকে তদবির করিয়ে দুর্নীতিবাজদের মামলা এবং অভিযোগ গুলো ধামাচাপা দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ১৫ বছরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি উপরে উপরে ছিলেন ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের একজন মানুষ। তার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতেন এপিএস আবুল বাশার। বিশেষ করে বড় ঠিকাদারি কাজ গুলো বন্টন করা হতো প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। বিকেল ৫ টার পর বাশার তার বাহিনী নিয়ে চলে যেতেন মতিঝিলস্থ বিআইডব্লিউটিএ'তে। বাশারের উৎপাতে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ'র উচ্চ পদস্থরা ছিলেন অতিষ্ঠ। তবে দুর্নীতিবাজরা থাকতেন সব সময় ফুরফুরে মেজাজে। এরাই মূলত: ঘাট ইজারা, উন্নয়ন কার্যক্রম ও জনবল নিয়োগে অনিয়ম এবং বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার কারসাজি করে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মন্ত্রণালয় এবং রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে যে সব ঠিকাদারকে মনোনীত করে দেয়া হতো তাদেরকে কাজ পাইয়ে দেয়ার গোপন আয়োজন করতেন উক্ত সিন্ডিকেটের সদস্যরা। সাড়ে তিনশ' ঘাটপয়েন্ট ইজারা দেয়া হয় আওয়ামীপন্থী স্থানীয় নেতা-কর্মীদের। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে দুদকে মামলা আছে।
উল্লেখ্য, সংস্থাটিতে বর্তমানে পাঁচ হাজার চারশ'র বেশি লোকবল রয়েছেন। গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের একদিন পরই করণীয় বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ। ওই বৈঠকে বেশ কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে বদলী, ওএসডি এবং দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত থাকা কর্মচারি-কর্মকর্তাদের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সরকারি সংস্থা ও দপ্তরে সরকারের সুবিধাভোগী দোসররা এখনো সক্রিয়। তারা নানাভাবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করার প্রয়াসে লিপ্ত রয়েছেন। সর্বোপরি তারা দেশে অচলাবস্থা সৃষ্টির জোর পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিআইডব্লিউটিএ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থা। এখানে বিগত সরকার আমলে যারা দুর্নীতি অনিয়নের মাধ্যমে শত শত কোটি হাতিয়ে নিয়েছেন তাদের আয়ের উৎস কি তা জানতে চায় বিআইডব্লিউটিএ' সাধারণ কর্মচারীগণ। একই সাথে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তা সরকারি কোষাগারে জমা জমা করার দাবিও জানিয়েছেন। সেক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সক্রিয় ও অনড় থাকলে সম্ভব বলে বিজ্ঞমহল মনে করেন।
আমার বার্তা/এমই