* সংবাদ করলে আইনি ঝামেলায় ফেলার হুমকি
* রাজনৈতিক ভোল পাল্টে নিজেকে বিএনপি ঘরানার উপস্থাপন
* আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্য সম্পদের তথ্য, দুদকের তদন্তে ধীরগতি
* দুর্নীতিতে বহু পুরানো অভিযুক্ত হয়েও অজানা শক্তিতে সবাই ম্যানেজ
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সম্পত্তি ও আইন শাখার পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন সংস্থার অতিরিক্ত পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন শাখা) একেএম আরিফ উদ্দিন। জনরোষে দেশ ছেড়ে পালানো শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদে তিনি ছিলেন বিআইডব্লিউটিএ’র অন্যতম সুবিধাভোগী। সরকার পতনের পর সংস্থার বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার রোষানল থেকে পরিত্রাণের আশা করলেও হয়েছে উল্টো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মুহূর্তেই পাল্টে গেছে আরিফের রাজনৈতিক চরিত্র। আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব, হাসিনার বন্দনা আর তাদের মন্ত্রীদের আশীর্বাদে থেকে বিআইডব্লিউটিএ’র দুর্নীতির সম্রাট হয়ে ওঠা আরিফ বলছেন, তিনি মূলত বিএনপিপন্থি মানুষ। বিগত আমলে মধু খেয়েও বর্তমান ও আগামীতে মধু খাওয়ার পথ ইতিমধ্যে সুগম করে ফেলেছেন তিনি।
আরিফ উদ্দিনের অতীত ঘেটে দেখা যায়, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল তার সখ্যতা। আরিফ উদ্দিন যতবার শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন ততবারই নিজের ফেসবুকে সেই ছবি প্রচার করে নিজের দাপট দেখাতেন। শেখ হাসিনার জন্মদিনে তুরাগ নদীতে নৌকা বাইচের আয়োজন করে একদিকে শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হিসেবে নিজের পরিচিতি লাভ করান। একই সঙ্গে সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান এবং খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর আশীর্বাদের হাতও ছিল তার ওপর। অগণিত অভিযোগ জমা পড়লেও এই দুই মন্ত্রীর কেউই আরিফের বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যবস্থা নেননি। আর প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের দাপটে নিজের পকেটে ভরেন সরকারি কাজের কোটি কোটি টাকা। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার জন্মদিন উদযাপনের নামে বিআইডব্লিউটি’র স্টেক হোল্ডার ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও কামিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। আরিফ উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি পাবনার সুজানগরের রায়পুর হলেও তার ছেলে সাদ ও মেয়ে অরিন দেশের বাইরে পড়াশোনা করেন। স্ত্রী শামীমা দীবা প্রায়ই সন্তানদের কাছে যাতায়াতের মধ্যে থাকেন।
অভিযোগ আছে, এ কে এম আরিফ উদ্দিন বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযানের নামে অন্তত ৫০ কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন মর্মে অভিযোগ আছে। এছাড়াও এ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সকে না জানিয়ে নদীর সীমানা পিলার স্থাপন, নারায়ণগঞ্জের পাগলায় চায়না কোম্পানির দু’টি জাহাজ নিলামে দেয়া, গাবতলীতে ১৭টি ট্রাক নিলামে দেয়া, নারায়ণগঞ্জে তার বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা, মালিকানাধীন জমি সরকারি বলে অন্যত্র লিজ দেয়া, বন বিভাগের জমি বিক্রি করা, কয়েক ব্যক্তির কাছ থেকে চার কোটি টাকা ঘুষ নেয়া, পুরান ঢাকার ইসলামবাগে ১৮টি বৈধ ভবন মালিকের প্রতিপক্ষ লোকজনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে সেসব ভবনগুলো ভাঙা, সদরঘাটে মসজিদ ভাঙা, লঞ্চের মাস্টারকে মারধর ও পিকনিকের লঞ্চে আর্মি অফিসার ও সচিবকে লাঞ্ছিত করাসহ ব্যাপক অপকর্ম করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে আরিফ উদ্দিনের পল্টি দিয়ে বনে গেছেন বিএনপির অনুসারী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএর কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জানিয়েছেন, এবার তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। কাউকে তোয়াক্কা করছেন না। আরিফ উদ্দিন নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকা নদী বন্দরে কর্মরত থাকাকালীন নিরীহদের উচ্ছেদ করলেও প্রভাবশালীদের ধারে-কাছেও যাননি। কথায় কথায় মানুষের শরীরে হাত তুলেছেন। গত স্বৈরশাসক আমলে তার কথা মতো কাজ না করলে মালিকানাধীন বৈধ ভবনও নিমিষের মধ্যে গুঁড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। আবার মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অবৈধ ভবন উচ্ছেদ না করাসহ নানা অপকর্মের কারণে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে কর্ম থাকাকালীন সময়ে ২২টি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ আছে, চার কোটি টাকা কন্ট্রাক্ট নিয়ে মদনগঞ্জ ট্রলার ঘাটের পাশে শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে মাহফুজুল ইসলামের আলিনা ডকইয়ার্ড ও শাকিলদের মুন্সি ডকইয়ার্ড অবৈধভাবে উচ্ছেদ করে কর্ণফুলী ডকইয়ার্ডকে জমি বুঝিয়ে দেন আরিফ উদ্দিন। এ ঘটনায় উচ্চ আদালতে রিট করেন মাহফুজুল ইসলাম। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে আরিফ উদ্দিন মীমাংসাও করেন ডকইয়ার্ড মালিকদের সঙ্গে। এতে মধ্যস্থতা করেন নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার তৎকালীন ওসি আবুল কালাম।
এখানেই থেমে নেই আরিফের কুকর্ম। জানা গেছে, কাঁচপুরে নদী তীরে বালু ভরাটের কাজে সহায়তার অভিযোগে মামলা হলে তাকে শোকজ করেন বিআইডব্লিউটিএর তখনকার চেয়ারম্যান কমডোর এম মোজাম্মেল হক। বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মদনগঞ্জ, কাঁচপুর, ঢাকেশ্বরী, রূপগঞ্জ এলাকায় মানববন্ধন করে হাজারো মানুষ। ডকইয়ার্ড মালিক মাছুম, আবুল কালাম বসু, মাহফুজুল ইসলাম ও শাকিলসহ অনেক ভুক্তভোগী আরিফের অপকর্মের শিকার হয়ে পথে বসেছেন।
ঢাকা নদীবন্দর কর্মকর্তা থাকাকালীন রাজধানীর লালবাগের পূর্ব ইসলামবাগ এলাকায় প্রায় ১৮টি বৈধভবন উচ্ছেদ করেন আরিফ উদ্দিন। এসব ভবন ভাঙার আগে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাসলাইন সংযোগ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করেননি। এমনকি ভবনে বসবাসকারীদের নামারও সুযোগ দেননি। এসব ভবন ভাঙার সময় প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। অনেকের বিল্ডিং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাদের কাছে ভবনপ্রতি লাখ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করায় তা না দিতে পারায় এমনটা করেছেন আরিফ।
২০১৮ সালের ৫ আগস্ট সদরঘাটে বায়তুল নাজাত মসজিদ ও মাদরাসা ভাঙা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটান আরিফ। এ সময় পাঁচজন আহত হয়। মসজিদের দুইটি দোকান ও মাসে ৪০ হাজার টাকা দাবি করলে তা দিতে চাননি মসজিদ ও মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। পরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি ও লালবাগ জোনের ডিসির নেতৃত্বে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। পরের দিন মন্ত্রীর নির্দেশে সংস্কার করে দেয়া হয় মসজিদটি। মূলত, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এবং খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ছিলেন তার টাকায় কেনা মন্ত্রী।
সদরঘাট থেকে একটি সংগঠন দুইটি লঞ্চ নিয়ে চাঁদপুরের দিকে পিকনিকে যাওয়ার আগে পোর্ট অফিসার আরিফ হানা দেন লঞ্চে। এ সময় আর্মি অফিসার, সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে লঞ্চ মাস্টারকে মারধরের পর লঞ্চের ঝাড়ু দিয়ে পোর্ট অফিসারকে পিটায় যাত্রীরা। কিন্তু আরিফ উদ্দিন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোক হওয়ায় মন্ত্রণালয় বা বিআইডব্লিউটিএ থেকে কোনো রকম পদক্ষেপ নেয়নি।
আরও অভিযোগ আছে, বসুন্ধরা রিভারভিউ (ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টিজ লিমিটেড), তুরাগ হাউজিং, মধু সিটি, মধুমতি মডেল টাউনসহ নদীর তীরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানিকে বিপুল পরিমাণ নদীর জমি দখলের সুযোগ করে দেয় একেএম আরিফ উদ্দিন, যার মূল্য আনুমানিক শত কোটি টাকার বেশি। এছাড়া নদীর সীমানা পিলার স্থাপনের নামে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। সঠিক জায়গায় সীমানা পিলার না বসিয়ে নদী দখলকারীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে সীমানা পিলার ঘুরিয়ে দিয়েছেন আরিফ। আওয়ামী লীগ আমলে আরিফের নেতৃত্বে স্থাপিত সীমানা পিলারের কার্যক্রম খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন ভুক্তভোগী জমির মালিক এবং নদীপ্রেমী জনগণ। ফোরশোর লিজ দেয়ার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আরিফ উদ্দিন। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসর আরিফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর শান্তিপ্রিয় কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ আগস্ট আরিফ উদ্দিনের দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি অভিযোগ জমা পড়ে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করেছে দুদক। সংস্থাটির উপ-পরিচালক মো. হাফিজুল ইসলাম (অনু ও তদন্ত-২) টিমের পক্ষ থেকে বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (প্রশাসন) বরাবরে এক চিঠিতে একেএম আরিফ উদ্দিনের নানাবিধ দুর্নীতি ও সম্পদ সংশ্লিষ্ট তথ্য চাওয়া হয়।
দুদকের চিঠিতে যেসব কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে তা হলো- বিআইডব্লিউটিএ আওতাধীন নারায়ণগঞ্জ পোর্ট হতে ১/১/১৯ইং-৩১/১২/২২ইং তারিখ সময়ে সদরঘাট পোর্ট হতে ১/১/২০২০ইং-৩১/১২/২২ইং তারিখ সময়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক খাতের হিসেবের বিবরণী। এ ছাড়াও আরিফের ব্যক্তিগত নথি, উত্তোলিত বেতন ভাতার বিবরণ, দায় দায়িত্ব সম্পর্কিত অফিস আদেশসমূহ, তার নিজ স্ত্রী/সন্তান/ভাইদের নামে ব্যবসা/শেয়ার পরিচালনায় আবেদন এবং অনুমোদন সংক্রান্ত সমুদয় রেকর্ডপত্র।
দুদকে জমা পড়া লিখিত অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে, এ.কে.এম আরিফ উদ্দিনের স্ত্রী শামীমা দীবার নামে ঢাকার ৩০১ এলিফ্যান্ট রোডে তার রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি। বারিধারা বসুন্ধরাতে ব্লক সি-এ তিনি বিলাসিতাপূর্ণ ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। পাশের একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করে ভাড়া দেয়া হয়েছে। পূর্বাচলে প্লট, বসুন্ধরায় অংশীদারিত্বে একটি ভবনের কাজ চলমান। এছাড়াও তার নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে পাবনাতে রয়েছে অসংখ্য সম্পত্তি, সুজানগরে রয়েছে অঢেল সম্পদ।
আরিফ উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এগুলো কিছুই সত্য নয়। আমি কোনো দুর্নীতি করিনি।’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের সঙ্গে সখ্যতার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বীকার করলেও কোনো জবাব দেননি। সন্তানদের বিদেশে পড়াশোনার বিষয়ে বলেন, ‘তারা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে গেছে।’ তবে তিনি নিজে কখনও বিদেশে যাননি বলে দাবি করেন। কথা বলার একপর্যায়ে এর আগে তাকে নিয়ে সংবাদ করা একটি পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন বলে মৃদু হুমকি দেন আরিফ উদ্দিন।
আমার বার্তা/জেএইচ