বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে ছাত্র আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে অধিকার আদায়ে মাঠে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের এক অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালে, ঢাকার ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে নামে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ছাত্রদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পরিণামে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৯৬৯ সালে, বাংলাদেশের ছাত্ররা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তোলে। এই আন্দোলনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়,ছাত্ররা মুক্তিবাহিনীর সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভাষা আন্দোলনের চেতনারই সম্প্রসারিত রূপ। ভাষা আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মৌলিক পার্থক্য বা ব্যবধান হলো পৃথক রাষ্ট্রগঠনের প্রত্যয়। এজন্য দেশভাগোত্তর পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষদের যে পরিমাণ মূল্য দিতে হয়েছে, তা বিশ্বের খুব কম সংখ্যক জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একাত্তরে হত্যা, ধর্ষণ, অত্যাচারের যে ভয়াল, বীভৎস ও নারকীয়তা এদেশীয় সর্বস্তরের মানুষের ওপর নেমে আসে, তা বর্ণনাতীত। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পর সেই বিবর্ণ ও বৈরী জীবন বাস্তবতার রূপনির্মাণ বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিক বহুবিধ ও বহুরৈখিকভাবে করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও এই প্রয়াস গতিশীল। সমগ্র বাঙালি জীবনের অবিস্মরণীয় আত্মাহুতি ও অর্জনের বিচিত্র অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা সময়ের দূরত্বে অবস্থান করে কবিকল্পনায় নির্মাণ-বিনির্মাণ করা সহজ না হলেও জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে তা সহজই।
মুক্তিযুদ্ধে জীবনকে বাজি রেখে শত্রুপক্ষের বর্বরতা আর নতুন রাষ্ট্রাকাঙ্ক্ষার প্রত্যয় ও চৈতন্যের প্রত্যক্ষ শিল্পরূপ নির্মাণ কঠিন। আর কঠিনতম শিল্পকর্মে সাহসী ভূমিকা রাখা জনগণের মধ্যে অগ্রজ হলেন ছাত্র সমাজ। বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরব ও অহঙ্কারের বিষয় হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। কোনো জাতির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে শরিক থাকা, সামান্যতম অবদান রাখতে পারা যে কোনো ব্যক্তির জন্য গর্বের ব্যাপার। আমাদের গৌরবের জায়গা হলো এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। শোষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি উদার, গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়েই এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পর একজন শিক্ষার্থীর প্রধান কাজ হলো পড়াশোনা করা, বিশ্বমানব হিসেবে নিজেকে মেলে ধরার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। কিন্তু আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কাজটি করতে এসে ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে কখনো সরকারি চাকরিতে বয়স বাড়ানোর সংগ্রাম করতে হচ্ছে, আবার কখনো কোটা সংস্কারের আন্দোলন। আর এসব করতে গিয়ে কখনো তাঁদের শরীরে রক্ত ঝরছে, আবার কখনো মানসিক নির্যাতন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। শেষ পর্যন্ত তা রক্তপাতে গড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকেরা রাতের আঁধারে মারধরের শিকার হয়েছেন। আহত হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন অনেকেই।স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর, দেশের উচ্চশিক্ষালয়ে এই চিত্রের যে পরিবর্তন হয়নি, তার দায়দায়িত্ব যে-ই নিক না কেন, আমাদের বাচ্চাদের মনে যে ঘৃণাবোধ জন্ম নিচ্ছে, তার দায় অন্তত এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকারকে নিতেই হবে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর তিন অস্ত্রধারীর গুলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদিও এই সব রক্তপাত-সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে দাবি আদায়ের কৌশল বহু পুরোনো; কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্বের এই সময়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের যেখানে দেশ নিয়ে ভাবার কথা, বৈশ্বিক ক্ষেত্রে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার লড়াই করার কথা, সেখানে এই শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামতে হচ্ছে, সেটা ভাবতেই কষ্ট লাগছে। তরুণ প্রজন্মের মনটা বিষিয়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু কেন এমন হবে? কেন আমাদের ছেলেমেয়েদের বারবার রাজপথে নামতে হবে? ভোটের বিতর্ক যেটাই হোক, সংবিধানের ধারাবাহিকতায় এই দেশে সংসদ সচল রয়েছে। সাড়ে তিন শ সংসদ সদস্য দেশের আইনপ্রণেতা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু কখনোই তাঁরা আমাদের তরুণ প্রজন্মের দুঃখের কথা, দুর্দশার কথা সংসদে গিয়ে বলেন না। সেখানে গিয়ে তাঁরা দাবি তোলেন না যে চাকরিব্যবস্থায় আমাদের একটি আদর্শিক-দৃঢ় নীতির প্রয়োজন।দুঃখ জনক হলেও সত্য, কোনো সংসদ সদস্যই শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি সেজে তাঁদের আক্ষেপগুলো সংসদে শোনাতে পারেননি, সরকারকে সম্পৃক্ত করাতে পারেননি। জনগণের করের টাকায় চলা সংসদের তাহলে কী নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত? বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে, আন্দোলন-সংগ্রাম না করলে কোনো যৌক্তিক দাবিই পূরণ হয় না। আর এসব দাবি পূরণে তাই সরকার প্রধানের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। এবারও সেটাই ঘটেছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে ছয় বছর আগে শিক্ষার্থীরা যে দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন, সেই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ক্ষতি করে দাবি আদায় করেছিলেন, সেই দাবিটিকে অসাড় করে দিয়ে ফের কেন তাঁদেরকে রাস্তায় নামতে হলো? শিক্ষার্থীরা তো কোটা বাতিল চাননি। কোটা বাতিল হয়েছিল সরকার প্রধানের নির্বাহী আদেশে। সেই আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। সেখান থেকেই নতুন করে জটিলতার শুরু। বাস্তবতা হচ্ছে, কোটাব্যবস্থার যে একটি সংস্কার প্রয়োজন, এ নিয়ে খুব মতভেদ আছে বলে মনে হয় না।
এখন কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় তা করা হবে, সেই পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা নীতিনির্ধারকদের থাকা উচিত। আমাদের মনে রাখা উচিত ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারের ভোটের একটি বড় অংশ ছিল ‘তরুণ’। এই তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, এই তরুণেরা জাগ্রত থেকে ২০১৩ সালে রাজাকার-আলবদরের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার ছিল। এই তরুণেরা এখন দেশের বিভিন্ন দায়িত্বে। ক্রমেই এই তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু চাক্ষুষ-বৈষম্যের জাঁতাকলে পড়া এখনকার তরুণদের নিজেদের ‘রাজাকার’ ট্যাগ লাগানো, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা কিংবা পক্ষ বানিয়ে ফেলার দায় তাহলে কার? এই তরুণদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা কতটা জরুরি ছিল? মনে রাখতে হবে, আজকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে রাস্তায় নেমেছেন মূলত বেকারত্ব ঘোচানোর জন্য।সরকারি চাকরিতে বৈষম্য দূর করতে একটি ঐক্য তৈরিতে তাঁরা সফল হয়েছেন, এই বিষয়টি আমাদের শাসকগোষ্ঠীর মানা উচিত। এই শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বোঝার সক্ষমতা সরকারের থাকা উচিত।বিরোধী দলের মতো শিক্ষার্থীদের যে প্রতিপক্ষ বিবেচনা করা উচিত নয়, সেই বোধ থাকা দরকার। প্রজন্মের এই রূপান্তরে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের শক্তিশালী করার দায়িত্ব যদি সরকার নিয়ে ফেলে, তাহলে মনে রাখতে হবে, আমাদের মহান স্বাধীনতার স্বপ্ন তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বা দিচ্ছে। জাতিগত বিভেদ আর আদর্শিক বিভেদের মতো তফাতটা আমাদের জানতে হবে। ক্ষমতাসীনেরা যদি মনে করেন, মুক্তি যোদ্ধাদের প্রতি সম্মানের জন্য যদি তাঁদের নাতি-পুতিদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি শক্তিশালী হবে, তা হলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী চাকরিক্ষেত্রে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নামতেন না।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যে শক্তিশালী করা যাবে না, সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। এর বদলে তাঁদের যোগ্যতাভিত্তিক সরকারি চাকরির সম-অধিকার ফেরাতে কোটা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা জরুরি। কোটা সংস্কারের জন্য কমিশন করুন, আলোচনা করুন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আর নারীদের অবস্থান নিশ্চিত করে কোটা সংস্কার জরুরি, তা মস্তিষ্ক দিয়ে বিচার করুন। মনে রাখতে হবে, বল প্রয়োগে যে ক্ষয় হবে বা হচ্ছে, তাতে কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা বলবান হচ্ছে। এখন সিদ্ধান্ত আপনাদের হাতে, আপনারা রক্তপাত করে তরুণদের মনকে আরও বিষিয়ে তুলতে চান, নাকি তাঁদের চিন্তাচেতনায় সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশকে রাখতে চান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে সে বিষয়টি নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা। যা নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে যেসব ছাত্ররা পড়তে আসে, তাদের বুকভরা স্বপ্ন থাকে, ছাত্ররাজনীতি সেসব ছাত্রের জন্য প্রথম আঘাত হয়ে দেখা দেয়। তারা যে স্বাধীনতা ও মহত্ত্বের স্বপ্ন দেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে, ছাত্ররাজনীতির অঙ্গীভূত দুরাচার প্রতিক্রিয়াশীলতা ও হানাহানি, এবং সেসবে তাদের বাধ্যতামূলক সম্পৃক্ততা তাদের নিকট প্রথম ধাক্কা হয়ে দেখা দেয়। ছাত্ররাজনীতি অসামান্য প্রতিষ্ঠান হতে পারতো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি কোনো না কোনো কারণে ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নেতা নির্বাচন করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারতো রাষ্ট্র। তা তো হয়ই নি, বরং কে বা কারা ছাত্ররাজনীতির যে কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ও গণতান্ত্রিক বিকাশের পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে। যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বার বার বিনষ্ট হচ্ছে এবং হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের জীবনের স্বপ্ন অকালেই ঝরে পড়ছে।
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসই হবে নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস,এই চেতনাকে শাণিত করতে আমাদের এখনই কাজ শুরু করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধ ছিলো বাঙালি জাতির শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো আমাদের বাঙালি জাতির আজন্মলালিত স্বপ্ন, একটি জাতির চেতনার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন দোলা দিয়েছে আমাদের মনে, আমাদের স্বপ্নকে অনুপ্রাণিত করেছে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। সহায়তা করেছে স্বপ্ন বাস্তবায়নে এবং এই স্বপ্নকে বেগবান করেছে এবং এক নতুন আশা ত্বরান্বিত করেছে। যে চেতনা বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করেছিল একটি গণতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায়। এই চেতনা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। নতুন প্রজন্মের চেতনাকে আরো শাণিত করতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।
আমার বার্তা/জেএইচ