মুক্তবুদ্ধি চর্চার ব্যাপারে বর্তমান সময়ে একদল তরুণ খুবই উৎসাহী। তারা মনে করে যে, মানুষ যেমন স্বাধীন তেমনি তার চিন্তা ও বুদ্ধিচর্চাও স্বাধীন, মুক্ত ও বাধনহীন। যে কোনো বিষয় নিয়ে ভাবতে পারবে ও তার বুদ্ধি প্রয়োগ করতে পারবে।
মুক্তমনাদের আস্থা মুক্তবুদ্ধিতে – অন্ধবিশ্বাসে নয়। কোন আপ্তবাক্য বংশ-পরম্পরায় প্রচলিত হয়ে এসেছে বলেই সেটাকে অবলীলায় বিশ্বাস করতে হবে এমন যুক্তি মুক্তমনারা মানেন না। তাঁরা মুক্তমনে প্রতিটি ধারনাকে যাচাই-বাছাই করতে চান। তারা বিজ্ঞানমনস্ক সংশয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি মিথ এবং অতিকথাকে বিশ্লেষণ করার পরে সিদ্ধান্তে পৌঁছান।
মুক্তবুদ্ধি মূলত- মুক্তচিন্তক, যুক্তিবাদী এবং মানবতাবাদীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত । মুক্তমনা বর্তমান সমাজে বিদ্যমান অদৃষ্টবাদ, ভাববাদ আর বিশ্বাসনির্ভর লাগাতার প্রকাশনা আর প্রচারণার বিপরীতে একটি বিজ্ঞানমনস্ক এবং যুক্তিবাদী ধারা প্রবর্তনে বদ্ধপরিকর। মুক্তমনার আত্মপ্রকাশ তাই শতাব্দী প্রাচীন ভাববাদী দর্শনের বিপরীতে, আজন্ম লালিত ধর্মীয় ও সামাজিক নিবর্তনমূলক সকল অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে। ২০০১ সালের ২৬শে মে তারিখে আলোচনাচক্রের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই মুক্তমনা মানব মনের বৌদ্ধিক বিকাশকল্পে যুক্তি-বুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার গুরুত্ববৃদ্ধিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মুক্তমনা ওয়েবসাইটটি অন্তর্জালে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ফ্রিথিঙ্কার, মানবতাবাদী, নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, সংশয়বাদী এবং যুক্তিবাদীর পদচারণায় ধন্য, এবং বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সফল প্রগতিশীল এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী সাইট হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
নাস্তিক (atheist), অজ্ঞেয়বাদী (agnostic), সংশয়বাদী (skeptic), মানবতাবাদীদের (humanist) সাধারণভাবে ‘মুক্তমনা সদস্য’ হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে – ধার্মিকেরা কি তাহলে মুক্তমনা হতে পারেন না? কোন ধার্মিক যদি মুক্তমনে তাঁর ধর্মবিশ্বাসকে বিশ্লেষণ করতে পারেন, তবে তাঁর নিজেকে মুক্তমনা বলতে আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা তা না করে নিজের ধর্মটিকেই আরাধ্য মনে করেন, কোন কিছু চিন্তা না করেই নিজের ধর্মগ্রন্থকে ‘ঈশ্বর-প্রেরিত’ বলে ভেবে নেন। স্রেফ ঘটনাচক্রে পৈত্রিক-সূত্রে পাওয়া যে ধর্মটিকে ‘নিজের’ বলে মনে করেন সেটাকেই ঈশ্বরের মনোনীত একমাত্র ধর্ম বলে বিশ্বাস করেন। আমাদের মতে কোন ব্যক্তি শুধুমাত্র শোনা কথার ভিত্তিতে বাইবেল, কোরান বা বেদকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে, বা নবী-রসুল-পয়গম্বর-মেসীয়তে বিশ্বাস করে নিজেকে কখনোই ‘ফ্রি থিঙ্কার’ বা মুক্তমনা বলে দাবি করতে পারেন না। মুক্তমনাদের আস্থা তাই বিশ্বাসে নয়, বরং যুক্তিতে।
বিজ্ঞানমনস্ক মন-মানসিকতা গঠনের উপর। মুক্তমনা মনে করে বিজ্ঞানমনস্ক মন-মানসিকতা এমনি এমনি গড়ে ওঠে না, গড়ে ওঠে যুক্তির পথ ধরে, নিরন্তর এবং ব্যাপক বিচার-বিতর্কের মাধ্যমে। আজ ইন্টারনেটের কল্যাণে বিশ্বাস এবং যুক্তির সরাসরি সংঘাতের ভিত্তিতে যে সামাজিক আন্দোলন বিভিন্ন ফোরামগুলোতে ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে, মুক্তমনারা মনে করে তা প্রাচীনকালের ব্রাক্ষ্মণ-চার্বাকদের লড়াইয়ের মত বিশ্বাস ও যুক্তির দ্বন্দ্বেরই একটি বর্ধিত, অগ্রসর ও প্রায়োগিক রূপ। এ এক অভিনব সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যেন বাঙালীর এক নবজাগরণ।
গত কয়েক বছরে স্বচ্ছ চিন্তাচেতনা সম্পন্ন মুক্তমনা যুক্তিবাদীদের বিশাল উত্থান ঘটেছে বিভিন্ন ফোরাম এবং আলোচনাচক্রে, যা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমে সম্ভব ছিল না মোটেই। জনগণের মধ্যে বিভিন্ন মত থাকা খুবই স্বাভাবিক এবং বিভিন্ন মতামতের দ্বন্দ্ব প্রয়োজনীয়, উপকারী এবং অনিবার্য। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণবিহীন স্বচ্ছ এবং সুস্থ বিতর্কের অবকাশ সৃষ্টি হলে জনগণের মধ্যে মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবোধের উপর আকর্ষণ বাড়বে এবং মিথ্যা বিশ্বাস পরিত্যাগ করে তারা ক্রমান্বয়ে যুক্তিনিষ্ঠ হয়ে উঠবে। যুক্তিনিষ্ঠ মন-মানসিকতাই অবশেষে জনগণকে পরিচালিত করবে আধ্যাত্মবাদ পরিত্যাগ করে মানবমুখী সমাজ বিনির্মাণে, সামিল করবে বঞ্চনা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সংগ্রামে। মুক্তমনার সদস্যরা তাদের ‘শখের তর্ক-বিতর্ক’কে ভিন্নমাত্রায় উন্নীত করে জনচেতনাকে একটি সঠিক পথ দেখাতে সর্বদা উন্মুখ।
নৈতিকতা’ ব্যাপারটিকে মুক্ত-মনারা কোন গায়েবী-বস্তু বলে মনে করে না। নৈতিকতা বিষয়টি মূলত জৈববিবর্তনীয় পথেই উদ্ভূত। সমাজে চারিদিকে চোখ রাখলেই দেখা যাবে, বহু নাস্তিক, ধর্মে-অবিশ্বাসী মানুষজন আছেন যারা অন্য সবার মতই রাষ্ট্রের আইন-কানুন মেনে চলেন, এবং ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে কেউ স্নেহময়ী মা অথবা দায়িত্ববান বাবা। অন্য মানুষের দুঃখ দেখে তারাও কাতর হন, দুস্থ মানুষের সেবায় তারাও অন্য সবার মতই এগিয়ে আসেন। কাজেই ধর্ম কোনভাবেই নৈতিকতার একমাত্র দাবিদার হতে পারে না। আসলে সামাজিক গবেষণায় দেখা গেছে, কোন বিশেষ ধর্মের আনুগত্যের উপর মানুষের নৈতিক চরিত্র-গঠন নির্ভর করে না, নির্ভর করে একটি দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট আর সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের উপর। অধিকাংশ আস্তিকই ‘ধর্ম’ এবং ‘নৈতিকতা’কে এক করে ফেলেন। ভাবেন ধর্মে আনুগত্য না থাকলে বা ঈশ্বরের ভয় না থাকলে সমাজ বুঝি উচ্ছন্নে যাবে। কিন্তু ঈশ্বরের ভয় দেখিয়েই যদি মানুষকে পাপ থেকে বিরত রাখা যেত, তা হলে তো রাষ্ট্রে পুলিশ, আইনকানুন, কোর্ট-কাচারি কোন কিছুরই আর প্রয়োজন হত না।
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি ১৯৮৮ সালে ভারতের জেলখানায় দাগী আসামীদের মধ্যে একটি জরিপ চালিয়েছিল। জরিপের ফলাফল ছিল অবাক করার মত। আসামীদের শতকরা ১০০ জনই ঈশ্বর এবং কোন না কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী। আজ বাংলাদেশে জরিপ চালালেও একই ধরনের ফলাফল পাওয়া যাবে। ঈশ্বরে বিশ্বাস, পরকালে বিশ্বাস, বেহেস্তের লোভ বা দোজখের ভয় কোনটাই কিন্তু অপরাধীদের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারেনি। আল্লাহর গুনাহর ভয়েই যদি মানুষ পাপ থেকে, দুর্নীতি থেকে মুক্ত হতে পারত, তবে তো বাংলাদেশ এতদিনে আক্ষরিক অর্থেই সোনার বাংলায় পরিণত হত। কিন্তু বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা আজ কী দেখছি? বাংলাদেশে শতকরা ৯৯ জন লোকই আল্লা-খোদা আর পরকালে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতিতে এই দেশটিই আজ পৃথিবীর শীর্ষে। ধর্মে বিশ্বাস কিন্তু দেশবাসীকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পারেনি। তাই আবারও ঠিক একই কথার উল্লেখ করতে হচ্ছে, ধর্ম কোনভাবেই নৈতিকতার ‘একমাত্র’ দাবিদার হতে পারে না।
নাস্তিক বা মুক্তমনারা কি ধার্মিকদের থেকে কম নৈতিক? এটা নির্ভর করছে ‘নৈতিকতা’ বলতে আসলে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে। যদি বিধাতার প্রতি বা ধর্মীয় আইন কানুনের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে ‘নৈতিকতা’ হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করা হয়, তবে তো মুক্তমনারা অবশ্যই ‘অনৈতিক’। তবে সাধারণভাবে কেউ যখন নৈতিকতার কথা বলেন তিনি মূলত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যায়-অন্যায়ের কথাই মূলত বলতে চান। আর সে হিসেবে মুক্তমনারা মোটেও অনৈতিক নন। অন্তত গবেষণায় তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। অধিকাংশ মুক্তমনাই মূলত মানবতাবাদী। অধিকাংশ মুক্তমনা ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করেছেন ধর্মের মধ্যে বিরাজমান নিষ্ঠুরতা আর অমানবিকতা উপলব্ধি করেই। তাই চুরি-ডাকাতি-খুন-ধর্ষণের মত সামাজিক অপরাধকে অপরাধ বলেই গণ্য করেন তারা।
➤বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চার অন্তরায়:
বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হয়। নিজের স্বাধীন মত চাইলেই কোন কিছু নিয়ে মন্তব্য করা কিংবা মুক্ত চিন্তা করা যায় না। মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে যে সকল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নিম্নে আমার মন্তব্য অনুযায়ী আলোচনা করা হলো।
১, ভয়- অনেকেই মুক্তবুদ্ধি বা মুক্তচিন্তা করতে চায়,কিন্তু তাদের মনে একটা সংশয় কাজ করে। সেটা হলো ভয়। এই ভয়কে যারা জয় করতে পারে তারাই হয় মুক্তমনা।
২, পরিবার- মুক্তমনা অন্যতম একটি বাঁধা পরিবার। শত বছর ধরে পালন করে আসা পৌরাণিক বিশ্বাসের উপর তারা প্রতিষ্ঠিত। মুক্তচিন্তকরা যখন নতুন কিছু নিয়ে আসে বা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে তখন প্রথম বাঁধাটা হয় পরিবার থেকে। পরিবার তাকে নানান ভাবে মুক্তপথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।
৩,সমাজ - সমাজ অন্যতম একটি সামাজিক ব্যবস্থা। আমাদের সবকিছু পরিচালিত হয় সামাজিকভাবে। সমাজ নিয়ে আমাদেরকে বসবাস করতে হয়। মুক্তচিন্তা করলে তখন সামাজিকভাবে একটা বয়কট বা একাকীত্ব করে দেয়। সামাজিকভাবে একজন মুক্তচিন্তক যখন একা হয়ে পড়ে তখনই তাকে পিছু টান নিতে হয়।
৪, বন্ধুবান্ধব- আমাদের সমাজে অধিকাংশই ধার্মিক এবং অন্ধবিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। একজন মুক্তচিন্তক গড়ে উঠে হাজারো অন্ধ ধার্মিক থেকে নিজের বুদ্ধিমত্তার উপর জোর দিয়ে। সত্যকে জানার জন্য, বোঝার জন্য, দেখার জন্য তিনি নিজের মধ্যে গড়ে তোলেন ভিন্ন জগৎ। কিন্তু একা হওয়া কিংবা কোন সঙ্গী না থাকায় বেশি দূর যেতে পারে না। তার সাথে যে বন্ধুবান্ধব চলাফেরা করে উঠাবে সহায় তারা সবাই তাকে কোনঠাসা করে ফেলে। নানান ভয় তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। ফলে সে আগের রাস্তায় চলে যায়।
৫,রাষ্ট্র ব্যবস্থা- মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে অন্যতম বাঁধা রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যখন কোন ব্যক্তি নিজের মতামত, নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করে তখন মৌলবাদীরা তাদের ইচ্ছা ছাপিয়ে দেয় ওই ব্যক্তির উপর। এমনকি তাদেরকে হত্যা করতে মৌলবাদীরা বিন্দুমাত্র চিন্তা করে না। ডঃ হুমায়ূন আজাদ থেকে শুরু করে অভিজিৎস সহ অনেককেই এভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের কিছুই করতে পারেনি। ফলে মৌলবাদীরা আরো হিংস্র হয় এবং মুক্তমনারা কিছুটা আতঙ্কে থাকে। নিজের চিন্তা মতামত কে প্রকাশ করতে চায় না।
➤মুক্ত বুদ্ধি চর্চার অন্তরায়ের উত্তরণ:
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি ধর্মনিরপেক্ষ হয়, উদার হয় তাহলে প্রত্যেকটা মানুষ, প্রত্যেক ব্যক্তি, নিজের অভিমত, নিজের ইচ্ছা, নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারবে। প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে নিজের মতামত প্রকাশ করার। কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিংবা কোন বিষয়কে বিশ্লেষণ করার। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার মধ্যে তার বিবেকে যতটুকু ধরে ততটুকুকে সম্মান করা। সামাজিকভাবেও এর একটা প্রবাব রয়েছে। পরিবারেও এর প্রভাব বিস্তার করে। তাই মুক্তচিন্তাকে বা মুক্তবুদ্ধিকে জাগিয়ে রাখতে তাদের সাথে মিশতে হবে যারা মুক্তচিন্তক এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চা করে। যারা অন্ধবিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে। খুঁজে খুঁজে মুক্তচিন্তক বের করে নিজেদের মধ্যে সংগঠিত হতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও সাহিত্যিক, শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ডেল্টা টাইমস/শহীদুল ইসলাম শুভ/সিআর/এমই