নববর্ষের সকাল মানেই চারপাশে এক চেনা সুরের আবহ ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। এই সুরের মধ্য দিয়ে যেন বৈশাখ আমাদের দরজায় কড়া নাড়ে, আর তার হাত ধরে আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রশ্ন জাগে নববর্ষের এই আনন্দঘন মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ কেন এত অবিচ্ছেদ্য?
বৈশাখ মানে শুধু বাংলা সালের প্রথম দিন নয়, এটি এক নতুন সূচনা। পুরনো জরা ঝেড়ে ফেলে জীবনকে নতুনভাবে দেখার আহ্বান। আর এই আহ্বানটির সবচেয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান ও ভাবনায়।
‘এসো হে বৈশাখ’ শুধু গান নয়, আত্মিক প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি শুধুই একটি রচনা নয় এটি একধরনের মানসিক শুদ্ধিকরণ। ‘দুঃখ-জীবনের জ্বালা-শোক ধুয়ে যাক, যাক পুরাতন স্মৃতি...’- এই আহ্বান শুধু প্রকৃতিকে নয়, আমাদের অন্তর্জগতকেও নতুন করে জাগিয়ে তোলে। বৈশাখের ঝড় এখানে এক প্রতীক; যা পুরনো ক্লেশ, হতাশা ও গ্লানিকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, আমাদের প্রস্তুত করে নতুন পথচলার জন্য।
এই গভীরতা রবীন্দ্রনাথের গানকেই শুধু অনন্য করে না, তাকে নববর্ষের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তোলে। বৈশাখে তার গান শুধু পরিবেশিত হয় না—তার গায়কীতে মিশে থাকে সংস্কৃতি, স্মৃতি ও আত্মার তৃষ্ণা।
রবীন্দ্রনাথ: ঋতু ও আত্মার কবি
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির ঋতুবোধকে সাহিত্য ও সুরের ছন্দে বেঁধেছেন। বসন্ত, বর্ষা, শরৎ—সব ঋতুর মতোই বৈশাখও তার কবিতায় ও গানে পেয়েছে আলাদা জায়গা। তবে বৈশাখ একটু বেশি কাছের। কারণ বৈশাখ মানেই নতুন জন্ম, আর রবীন্দ্রনাথ বারবার জন্ম ও নবজাগরণের কথা বলেছেন।
তিনি বৈশাখকে শুধু একটা ঋতু বা তারিখ হিসেবে দেখেননি। তিনি দেখেছেন তাকে এক বোধ হিসেবে। সেই বোধে রয়েছে প্রার্থনার রেশ, রয়েছে আত্মিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
নববর্ষে রবীন্দ্রসংগীত: সংস্কৃতি না স্টাইল?
বর্তমানে নববর্ষ মানেই স্টেজ শো, পান্তা-ইলিশ, আর ফেসবুক স্টোরি। সেখানে ‘রবীন্দ্রসংগীত’ কি কেবল আনুষ্ঠানিকতা? নাকি এখনো কেউ কেউ তাকে অন্তর থেকে অনুভব করে?
অনেকেই হয়তো জানে না, নববর্ষকে কেন্দ্র করে রচিত রবীন্দ্রনাথের বহু গানেই রয়েছে সময়ের রূপান্তর, আত্মদর্শন ও আশাবাদের প্রকাশ। তার গানগুলো আজও তাই শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে রয়ে গেছে; যেখানে সাজসজ্জা নেই, আছে শুধু হৃদয়ের আত্মনিয়ন্ত্রণ।
শহরের কোলাহলে যখন উৎসবটা অনেক সময় মুখোশে ঢাকা পড়ে যায়; তখন গ্রামের কোন পাড়ায় সকালে উঠে কেউ চুপিচুপি গেয়ে ওঠে ‘আজি নববর্ষের প্রথম প্রভাতে’ তখন সেখানে রবীন্দ্রনাথ আসেন নিঃশব্দে, এক নির্লিপ্ত বন্ধুর মতো।
রবীন্দ্রনাথ কেন এখনো প্রাসঙ্গিক?
একটি গান যখন প্রজন্ম পার হয়ে এসেও নতুনের গান হয়ে ওঠে, তখন বুঝতে হয় এটি শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্ম নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়। রবীন্দ্রনাথের গানে ঋতু যেমন বদলায়, তেমনই সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। বৈশাখের গানেও তাই যুগ যুগ ধরে মানুষ খুঁজে পেয়েছে নিজের অস্তিত্ব। একটুখানি রোদ, একটু ধুলো, আর রবীন্দ্রসংগীত; এই মিশ্রণেই যেন বৈশাখ সম্পূর্ণ হয়।
বৈশাখ ও রবীন্দ্রনাথ: এক অনন্ত সুর
বৈশাখ আসবে প্রতিবছর, সাজ বদলাবে, রীতিনীতির ধরন বদলাবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ থাকবেন। কারণ তিনি শুধু একজন কবি নন; তিনি আমাদের অনুভূতির ভাষা, উৎসবের ছায়া, আত্মার আরাম।
এই নববর্ষেও যখন চারপাশে অনেক কিছুর ঘনঘটা থাকবে, তখন নিজের ভেতর একটু চুপ করে বসে রবীন্দ্রনাথকে শুনে দেখা যেতে পারে। তার গান তখন হয়তো কানে নয়, হৃদয়ের গভীরে বাজবে। হয়তো এক সুরেই নতুন বছরের শুরুটা হয়ে উঠবে সত্যিকারের ‘নতুন’।