দেশে ভয়াবহ হারে বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা।ধর্ষণ শুধু একটি অপরাধ নয়, এটি সভ্যতার শিরায় গভীর ক্ষত, মনুষ্যত্বের ওপর জোরালো আঘাত। এটি শারীরিক লাঞ্ছনার চেয়েও ভয়াবহ এক মানসিক হত্যাযজ্ঞ। ধর্ষণের প্রতিটি ঘটনা প্রমাণ করে, অপরাধীর আসল অস্ত্র তার পাশবিক শক্তি নয় তার মানসিকতা। সমাজে তখনই অপরাধের বিস্তার ঘটে, যখন অপরাধ দমনের চেষ্টা কেবল বাহ্যিক প্রতিরোধে সীমাবদ্ধ থাকে, অথচ মানসিক গলদগুলো অক্ষত থেকে যায়। ধর্ষণ মূলত এক মনস্তাত্ত্বিক দানব, যার জন্ম হয় মানসিক বিকৃতি থেকে, লালিত হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে, আর বিকশিত হয় পুরুষতান্ত্রিক দম্ভে।বাংলাদেশে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও ধর্ষণ কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। বরং প্রতিনিয়ত ধর্ষণের সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে। কারণ শাস্তি বাহ্যিক বাধা, অপরাধী মানসিকভাবে অপরাধপ্রবণ থাকলে শাস্তির ভয় তাকে থামাতে পারে না। আইন তখনই কার্যকর হয়, যখন সমাজের মানসিকতা তার পক্ষে দাঁড়ায়। কিন্তু যদি অপরাধীর মনে নারীকে অধীন ভাবার, ভোগ্য পণ্য ভাবার দানবীয় মানসিকতা গেঁথে বসে, তাহলে আইন তাকে পিছু হটাতে ব্যর্থ হয়।
আইন অপরাধের পরে সক্রিয় হয়, কিন্তু ধর্ষণ প্রতিরোধের সত্যিকার যুদ্ধ শুরু হয় অপরাধের আগে মনোজগতে। বিকৃত মানসিকতা গজিয়ে উঠেলে শাস্তির ভয় অপরাধকে দমন করতে পারে না। তাই, আইন এবং কঠোর শাস্তি যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, তা কেবল ফাঁপা ঢোল বাজানোর মতো, যদি মানসিক উন্নয়নকে কেন্দ্রবিন্দুতে না রাখা হয়। মানসিক উন্নয়নের মাধ্যমে প্রত্যেকে যদি নারীকে সম্মান করতে শিখে, নারী কোন ভোগ্যপণ্য নয় এই নীতি যদি নিজের ভিতর ধারণ করে তাহলে ধর্ষণের ঘটনাই তো ঘটবে না সমাজে।ধর্ষকের মনোজগত এক দিনে গঠিত হয় না; এটি দীর্ঘদিনের মানসিক বিকৃতি ও সমাজের অসুস্থ সংস্কৃতির ফলাফল। ছোটবেলা থেকে পরিবার, সমাজ এবং মিডিয়া শিশুর মানসিক কাঠামো নির্মাণ করে।ধর্ষণ, এক অদৃশ্য অথচ সুদৃঢ় পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকৃত ফসল। সমাজ বারবার পুরুষকে শেখায় ক্ষমতার মানে আধিপত্য, যৌনতার মানে জয়লাভ। নারীকে অধীনস্থ ভাবার এই মানসিকতা ধর্ষণকে শুধু উৎসাহিত করে না, বরং একে ন্যায়সঙ্গত করতেও প্ররোচিত করে। শুধু তাই নয় যখন সমাজে নারীর পরিচিতি সীমাবদ্ধ হয়ে যায় কেবল তাদের শরীর ও সৌন্দর্যের বর্ণনায়, তখন তরুণ মনের কাছে নারী হয়ে ওঠে কেবল যৌন বস্তু ও ভোগ্য পণ্য। পাশাপাশি সিনেমা, বিজ্ঞাপন, এবং অশ্লীল কন্টেন্ট যখন নারীর মর্যাদাকে ক্ষতবিক্ষত করে, তখন মনস্তাত্ত্বিকভাবে তারা ভাঙনের পথে হাঁটে।তবে অনেক অপরাধী ধর্ষণকে কেবল যৌন তৃপ্তির জন্য নয়, বরং প্রতিশোধ, শাসন এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবেও দেখে। এটি তাদের অপ্রাপ্তিবোধ, হতাশা ও অবদমিত রাগের এক বিস্ফোরণ।
অনেক ধর্ষকের মানসিক বিকৃতি আবার শুরু হয় শৈশবে পরিবার থেকে। পরিবারে বাবার হাতে মায়ের প্রতি নির্যাতন, নারীর অসম্মান, এবং ছেলেশিশুর দম্ভ এসব একসঙ্গে দেখে তার মধ্যে এক বিকৃত মানসিকতার বীজ বপিত হয়।কঠোর শাস্তি অবশ্যই অপরাধ দমনে ভূমিকা রাখে, কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার শিকড় উপড়ে ফেলতে পারে না। মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অপরাধীর শরীর শেষ করে, কিন্তু তার মনোভাবের সেই অন্ধকার অক্ষত থেকে যায়, যা পরবর্তী প্রজন্মে সংক্রমিত হয়। ধর্ষণ ঠেকানোর আসল কৌশল শাস্তির ভয় নয়, অপরাধ প্রবণতার মানসিক উৎস ধ্বংস করা।তাই শৈশব থেকে শিশুদের শেখাতে হবে যে নারী কোনো বস্তু নয়,সে একজন স্বাধীন মানুষ। পাঠ্যবইয়ে নারীর ভূমিকা ও মর্যাদা জোরালোভাবে উপস্থাপন করা জরুরি। ছেলে-মেয়ের মধ্যে সমতার ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে হবে পরিবার থেকেই।পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা উপড়ে ফেলার এটাই হয়ে উঠবে প্রথম ধাপ।মানসিক কাউন্সেলিং ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও জরুরী।স্কুল-কলেজে ছেলেদের আচরণ মনিটর করতে হবে। যে ছাত্র নারীদের প্রতি অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা, কিংবা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ করবে তাকে মানসিক কাউন্সেলিংয়ের আওতায় আনতে হবে। বিকৃত মানসিকতা শনাক্ত করে তাৎক্ষণিক প্রতিকার করতে হবে।দেশে যৌন শিক্ষার অভাব অপরাধী মানসিকতার পেছনে এক বড় কারণ। শিশুদেরকে সম্মতির ধারণা, শরীরের ব্যক্তিস্বাধীনতা, এবং যৌন আচরণের সামাজিক বিধি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেবার সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । এই পদক্ষেপ অপরাধপ্রবণ মানসিকতাকে নিরসন করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। মিডিয়াতে গান, নাটক, এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যে নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়, তা এক নিঃশব্দ মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা। এ ধরনের প্রচারণা আইন করে নিষিদ্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি জনমনে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক।
যে অপরাধীরা ধর্ষণ করেছে, তাদের শুধুমাত্র কারাগারে বন্দি রেখে সংশোধন সম্ভব নয়। অপরাধীদের মানসিক বিশ্লেষণ, তাদের অবদমিত রাগ, ক্ষমতালিপ্সা এবং বিকৃত চিন্তাভাবনার উৎস চিহ্নিত করে মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি দিতে হবে।ধর্ষণবিরোধী মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে প্রতিবাদী সমাজ গড়ে তুলতে হবে। নির্যাতিতাকে দোষারোপের সংস্কৃতি বদলাতে হবে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে অপরাধীকে সামাজিকভাবে একঘরে করা, তার মানসিক গঠন বিশ্লেষণ করা এবং অপরাধীর মানসিক দুর্বলতা জনসমক্ষে তুলে ধরা জরুরি।ধর্ষণ রোধে, আইন বা শাস্তির পাশাপাশি, মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নই আসল শক্তি, কারণ এই জাতীয় অপরাধের মূল শিকড় নিহিত থাকে আমাদের মনস্তত্ত্বে, আমাদের চিন্তাভাবনায়, এবং আমাদের সামাজিক গঠনে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেবল চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে পারে, কিন্তু ধর্ষণ নামক মানসিক রোগের প্রতিকার সমাজকেই করতে হবে। অপরাধীর মনস্তাত্ত্বিক শিকড় যতদিন অক্ষত থাকবে, ততদিন নতুন অপরাধীর জন্ম হবেই। তাই ধর্ষণ প্রতিরোধে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়ন যা নারীর প্রতি আক্রমণ রোধের পাশাপাশি মানবতা এবং নৈতিকতার বৃহত্তর অঙ্গীকার গড়ে তুলবে। যখন আমরা যৌন নিপীড়ন এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারব, তখনই আমাদের সমাজে একটি দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর পরিবর্তন আসবে।তাই ধর্ষণ রোধে সর্বোচ্চ হাতিয়ার মনের অন্ধকার দূর করে সুন্দর ও পবিত্র মানসিকতার আলোয় সকলকে আলোকিত করার শপথ গ্রহণ করতে হবে। তবেই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে প্রতিটি নারীর জন্য ধর্ষণমুক্ত নিরাপদ এক আবাসভূমি।
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ।
আমার বার্তা/জেএইচ