শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের রোডম্যাপ (পথনকশা) ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পথনকশা অনুযায়ী গত ১ ফেব্রুয়ারি তফসিল ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু ছাত্রসংগঠনগুলোর মতবিরোধের কারণে কর্তৃপক্ষ তফসিল ঘোষণা করতে পারেনি। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে নির্বাচন হবে। তফসিল ঘোষণা হবে নির্বাচনের ২১ দিন আগে (৩০ এপ্রিল)। তবে নির্ধারিত সময়ে তফসিল ঘোষণা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ বক্তব্য অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার মাত্র ১০ দিন বাকি। কিন্তু জাকসুর গঠনতন্ত্র এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ ছাড়া জুলাই আন্দোলনে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা এবং যাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের নামও প্রকাশ করেনি কর্তৃপক্ষ। ফলে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
যদিও ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন, ভোটার তালিকা প্রকাশ, পরিবেশ পরিষদ গঠনসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হলে হলে মতবিনিময় সভাও হয়েছে। বিভিন্ন অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে গঠনতন্ত্র সংস্কারের বেশ কিছু প্রস্তাবও তৈরি করেছে কর্তৃপক্ষ। এসব প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কাছে লিখিত চিঠি দিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। ১৭ এপ্রিল ছিল মতামত দেওয়ার শেষ দিন।
১৯৭২ সালে জাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। সে বছরই হয় প্রথম নির্বাচন। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছে ১৯৯২ সালে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাকসু নির্বাচনের দাবিতে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, আমরণ অনশনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ৩০ ডিসেম্বর জাকসু নির্বাচনের পথনকশা ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তৌহিদ সিয়াম বলেন, রোডম্যাপ ঘোষণার পর একটি সংগঠনের বিরোধিতার কারণে কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ে তফসিল ঘোষণা করতে পারেনি। নতুন করে প্রশাসন যে তারিখ দিয়েছে, তার মধ্যেই নির্বাচন হবে বলে তাঁরা আশা রাখতে চান। তবে এর আগে যেসব কাজ হওয়ার কথা, সেগুলো প্রশাসনের দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। আর কোনো অজুহাতে জাকসু নির্বাচন পিছিয়ে যাক, সেটা তাঁরা চান না।
ক্যাম্পাসে সক্রিয় ‘গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের’ আহ্বায়ক আবদুর রশিদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল গঠনতন্ত্র সংস্কার, ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি যথাসময়ে সম্পন্ন করা হবে। ১০ এপ্রিলের মধ্যে তফসিল ঘোষণার নির্দিষ্ট তারিখ জানিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কর্তৃপক্ষের দিক থেকে এখনো কোনো ঘোষণা আসেনি। যদি কোনো অজুহাত দেখিয়ে আবারও তফসিল ঘোষণা বা নির্বাচন আয়োজন পেছানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে এর পরিণতি শুভ হবে না।’
প্রশাসন একটা সময় দিয়েছে যে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে নির্বাচন হবে। এটা প্রশাসন বলেছে, নির্বাচন কমিশন বলেনি। এ ছাড়া গঠনতন্ত্র সংস্কারের পর সেটি আমাদের কাছে দেওয়া হবে। এরপর আমরা সেটা নিয়ে বসব এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তারিখ জানাতে হবে।
এ বিষয়ে জাকসু নির্বাচনের জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রাশিদুল আলম সম্প্রতি বলেন, গঠনতন্ত্র সংস্কারের প্রস্তাবনায় অংশীজনের মতামত শেষে ২০ এপ্রিল আলোচনায় বসে একটি চূড়ান্ত খসড়া করা হবে। খসড়া উপাচার্যের কাছে দেওয়া হবে। এরপর সিন্ডিকেটে তোলা হবে। নির্ধারিত সময়েই তফসিল ঘোষণার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেনি উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘প্রশাসন একটা সময় দিয়েছে যে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে নির্বাচন হবে। এটা প্রশাসন বলেছে, নির্বাচন কমিশন বলেনি। এ ছাড়া গঠনতন্ত্র সংস্কারের পর সেটি আমাদের কাছে দেওয়া হবে। এরপর আমরা সেটা নিয়ে বসব এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তারিখ জানাতে হবে। এরপর আমরা তফসিল কবে ঘোষণা করতে পারব, সেটি জানাতে পারব।’
রোডম্যাপ ঘোষণার শুরু থেকেই ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে মতবিরোধ ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন, ছাত্রশিবির, ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ), আধিপত্যবাদবিরোধী মঞ্চ, ছাত্র অধিকার পরিষদসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন পথরেখা অনুযায়ী নির্বাচন দাবি করছিল। অন্যদিকে ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ) ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কিছু বিষয় সংস্কার করে নির্বাচন আয়োজনের দাবি করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে জাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কারের কাজ এগিয়ে নেওয়াসহ বেশ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এখনো ছাত্রসংগঠনগুলোর মতবিরোধ কাটেনি।
ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একাংশের সাধারণ সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলি বলেন, নির্বাচন এগিয়ে নিতে প্রশাসন যে কাজ করছে, সেটিকে সাধুবাদ জানান তাঁরা। তবে পাশাপাশি প্রশাসন থেকে আওয়ামী দোসরদের সরাতে হবে এবং গত ১৫ বছরের সব দুর্নীতির তদন্তকাজও এগিয়ে নিতে হবে। জাকসু নির্বাচনের পাশাপাশি সিনেট, সিন্ডিকেট ও রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচনেরও উদ্যোগ নিতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, ‘জাকসু নির্বাচনের জন্য সবকিছু ঠিকঠাকভাবে এগোচ্ছে। সবাই একমত হলে নির্ধারিত সময়ে তফসিল ঘোষণা করতে পারব।’
আমার বার্তা/এল/এমই