গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে একটি দেশের দিকে। মনে হচ্ছে পৃথিবী মানেই আমেরিকা।আসলেই কি তাই? অরাজকতা, অন্যায়, অত্যাচার থেকে শুরু করে ভালো-মন্দ সব কিছুরই প্রভাব রয়েছে সেখানে। আবার অনেকে ঠিক সেই দেশ থেকেই মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে, চমৎকার। প্রশ্ন হচ্ছে-কী এমন জাদু রয়েছে আমেরিকায়? চীনও কিন্তু একটি বেশ জনবহুল দেশ। এটা সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাকস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। যদিও চীন বা রাশিয়া শক্তিশালী অর্থনীতি এবং সামরিক ক্ষমতা রাখে, তাদের গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবের কারণে তারা বিশ্বের কাছে আমেরিকার মত আকর্ষণীয় হতে পারেনি। মানুষ জাতির বৈশিষ্ট্য হিসেবে নতুন কিছু দেখার এবং উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করার প্রবণতা রয়েছে। ফলে, যুক্তরাষ্ট্র তার গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার উদাহরণ দিয়ে অন্য দেশের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে শিল্পোন্নত দেশগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা তাকে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈচিত্র্যময় শিল্প খাত,যেমন প্রযুক্তি,অর্থনীতি এবং ভোগ্যপণ্য বাজারে প্রাধান্য, তার বিশ্বব্যাপী আর্থিক নেতৃত্বকে আরও দৃঢ় করেছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি যেমন অ্যাপল,গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানের আবাসস্থল যুক্তরাষ্ট্র হওয়ায় এর প্রযুক্তিগত আধিপত্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাব বহুদিন ধরে বিশ্বব্যাপী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে তার নীতিগুলিকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা বহুমাত্রিক প্রভাব বিস্তার করে। যেমন, জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এবং বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিষয়টি তাদের বৈশ্বিক প্রভাবকে আরও সুসংহত করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক বন্যা ও আফ্রিকার খরা ছিল বিপর্যয়কর, তবুও তারা বিশ্বের সবচেয়ে অস্থির, অঞ্চল ও ঝুঁকিপূর্ণ লোকদের চেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত। কেননা, সম্প্রতি বিলিয়ন ডলার মার্কিন সাহায্যের আকস্মিক প্রত্যাহারের ঘটনা বন্যা ও খরার চেয়ে বেশি মানুষকে প্রভাবিত করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গাজা দখল পরিকল্পনার পাশাপাশি ইউএসএইডের তহবিল বন্ধ করার ইচ্ছা স্পষ্ট বার্তা দেয়। কিন্তু যখন গাজা সিদ্ধান্ত এখনও পরিকল্পনাধীন, ইউএসএইড প্রত্যাহারে তহবিল কমে আসবে। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতবেদন অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ১০ হাজারেরও বেশি কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ২৯০ জনের চাকরি বহাল থাকবে।এশিয়ায় ল্যান্ড মাইন তুলে আনার কাজ বন্ধ করা, ইউক্রেন যুদ্ধের অভিজ্ঞ সৈনিক ও স্বাধীন মিডিয়ার সমর্থন এবং বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সহায়তা করতে দেখেছি।সম্প্রতি আফ্রিকায় এমপক্স ও ইবোলা প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে; আফ্রিকার বন্দরে জীবন রক্ষাকারী খাবারে পচন ধরেছে। এমনকি ফেন্টানাইলের মতো মাদক পাচারের লক্ষ্য রেখে গৃহীত উদ্যোগও বন্ধ করা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় দাতব্য সংস্থাগুলোর একটি ব্র্যাক। তারা বলেছে, দুর্বল লোকদের সাহায্য করার ৯০ দিন কম্বল বিতরণ কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে ৩.৫ মিলিয়ন মানুষ গুরুত্বপূর্ণ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের ক্ষেত্রে সীমিত মওকুফ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের গৃহীত একটি উদ্যোগ হলো পেপফার। এর মাধ্যমে এইচআইভি ও এইডসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সারাবিশ্বের ২০ মিলিয়ন মানুষকে অ্যান্টিরেট্রো ভাইরাল প্রেসক্রিপশন দেওয়া হয়। ৯০ দিনের বিরতিতে ১ লাখ ৩৬ হাজার শিশু এইচআইভিতে আক্রান্ত হতে পারে-এমন সতর্কতার পরেই প্রকল্পের কার্যক্রম নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষা পায়।
তবে এখনও সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের স্ক্রিনিং, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ও পোলিওর চিকিৎসা, মা ও শিশুস্বাস্থ্যে সহায়তা এবং ইবোলা, মারবার্গ ও এমপক্সের প্রাদুর্ভাব কমানোর প্রচেষ্টায় তহবিল প্রদানে নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। ট্রাম্প বলেছেন, ইউএসএইড এক গুচ্ছ উগ্র উন্মাদ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল এবং আমরা তাদের বের করে দিচ্ছি।’ তাঁর মুখপাত্র এ ব্যাপারে বলেন, ‘আমি চাই না, আমার ডলার এভাবে নষ্ট হোক।’প্রেসিডেন্টের প্রধান উপদেষ্টা ইলন মাস্ক ওই এজেন্সিকে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘৃণা করে এমন উগ্র বাম মার্ক্সবাদী বিদ্বেষকারীদের বাসস্থান বলে চিহ্নিত করেছেন। এ সময় তিনি বলেন, আপনাকে মূলত পুরো পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হবে। এটা মেরামতের বাইরে চলে গেছে। তিনি বলেন, আমরা এটি বন্ধ করতে যাচ্ছি। সম্প্রতি এক্স পোস্টে মাস্ক একটি স্ক্রিনশট শেয়ার করেছেন। এতে মিথ্যা দাবি করা উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইউএসএইডের মাধ্যমে সরবরাহকৃত আমাদের বৈদেশিক সহায়তার ১০ শতাংশেরও কম প্রকৃতপক্ষে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় না।’ বাকি ৯০ শতাংশ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, চুরি করা হয়েছে বা কেবল নষ্ট করা হয়েছে। মূলত এই ১০ শতাংশ উন্নয়নশীল বিশ্বের এনজিও এবং সংস্থাগুলোর কাছে সরাসরি বাজেট থেকে বরাদ্দ থাকে। অবশিষ্ট ৯০ শতাংশ নষ্ট হয় না। পরিবর্তে এতে সব ধরনের পণ্য ও সেবা অন্তর্ভুক্ত। এরই মাধ্যমে ইউএসএইড, মার্কিন কোম্পানি, এনজিও এবং বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলো এইচআইভি ওষুধ থেকে শুরু করে জরুরি খাদ্য সহায়তা, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক মশারি ও অপুষ্টির চিকিৎসা খাতে তহবিল বিতরণ করা হয়। এটি সোজাসাপ্টা অসত্য যে, ৯০ শতাংশ সহায়তা বেঠিক হাতে পড়ে এবং কখনও সবচেয়ে দুর্বলদের কাছে পৌঁছায় না।এই নতুন অবস্থানটি কেবল আমেরিকা ফার্স্ট প্রকল্পের বেলায় প্রযোজ্য নয়।বরং আমেরিকা প্রথম ও একমাত্র; আর হামাস, আইএস, হুতি বিদ্রোহী এবং যাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহাবস্থান অসম্ভব, তাদের স্পষ্ট করে জানান দেওয়া।
নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটি চীনের জন্যও সুসংবাদ, যার নিজস্ব বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ শক্তিশালী হবে। কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্রের জায়গায় নিজেকে বসানোর মতো পরিস্থিতি। তহবিল সহায়তা বাতিল করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়বে। মার্কিন উদারতাকে প্রায়ই নিছক দাতব্য হিসেবে দেখা হয়। তবে উদার হওয়ার কারণ দেশের স্বার্থ। কারণ আরও স্থিতিশীল বিশ্ব সৃষ্টি আমাদের সবার উপকার করে। ইউএসএইড যদি সংক্রামক রোগের বিস্তার কমাতে; গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো ও সুদানে অপুষ্টি রোধ করতে; সিরিয়ায় আইএসের উত্থান থামাতে এবং গাজা ও ইউক্রেনের একটি ন্যায্য, মানবিক পুনর্গঠনে সমর্থন করতে পারে, তাহলে আমরা সবাই লাভবান হবো। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ শুধু সংকীর্ণ ও সবচেয়ে ধোঁয়াশাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিই বহন করে, যা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তারই পক্ষে সাফাই গায়।ট্রাম্প প্রশাসন সাধারণত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে প্রাধান্য দেয় এবং মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের মতো বিষয়গুলোতে আগ্রহ কম থাকে। এর মানে, ভারতের মতো শক্তিশালী মিত্র দেশগুলোর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ ট্রাম্প প্রশাসন থেকে প্রত্যাশিত সমর্থন পেতে পারে না, বিশেষ করে যদি এ ধরনের সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বা অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে না মেলে। ড.ইউনুসের মতো ব্যক্তিত্বদের নিয়ে যে কোনো ধরনের সমালোচনা বা অভ্যন্তরীণ চাপের ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ডেমোক্র্যাটিক নেতৃত্বের মতো দৃঢ় হবে না। ট্রাম্প সাধারণত মানবাধিকার বা গণতন্ত্র নিয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চান না, বিশেষত যদি তা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বা কৌশলগত স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত না হয়। রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও এখন হুমকির মাধ্যমে এসব বাস্তবায়ন অবশ্যই একটি বড় উদ্যোগ; যেমনটি তিনি কলাম্বিয়ার ক্ষেত্রে করেছিলেন; প্লেন ভর্তি অভিবাসীদের ফেরত পাঠিয়েছেন এবং এখন মেক্সিকোকে সীমান্তে সেনা নিয়োজিত করতে বাধ্য করেছেন।
এমন কোনো দাবি যদি তিনি যুক্তরাজ্যের কাছে করেন তাহলে অন্যথা হওয়ার সুযোগ কম। ট্রাম্পের কাছে করের বদলে ট্যারিফ বাড়িয়ে অর্থ আদায়ের পথ বেশি সহজ বলে মনে হয়েছে।শুধু নিজের নীতিগত এবং শক্তিমত্তাগত অবস্থানের কারণে সহযোগীদের ওপর তিনি ট্যারিফ বাড়াচ্ছেন। এ ট্যারিফ বাড়ানোয় আদৌ কি লাভ হবে? যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এমনিতেই মূল্যস্ফীতির চাপে জর্জরিত। এখন তাদের আমদানি করা পণ্যে আরও বেশি খরচ করতে হবে। এমনকি নিজেদের বাড়িতেও আমদানি করা পণ্য ব্যবহার করতে গেলে খরচ বাড়বে। অথচ এ বিলিয়ন ডলার যৌক্তিক হারে ট্যাক্স মওকুফের মাধ্যমেও সমাধান করা সম্ভব ছিল। আর যদি রাষ্ট্রপতি এক রাতের ব্যবধানে নিজেদের বিশ্বের প্রথম সারির অর্থনীতি হিসেবে তৈরি করতে চান তাহলে আয়কর থেকে সমন্বয় করে কিংবা ধনিক গোষ্ঠীর ভোগ করা পণ্যের ওপর করের হার বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে অন্যদের অর্থনীতিও স্থিতিশীল করতে হবে। যেহেতু কেউই যুক্তরাষ্ট্রকে আবার গরিব করার জন্য ভোট দেয়নি, সাধারণ মার্কিনিরা হয়তো দ্রুতই ক্লান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু ব্রেক্সিট দেখিয়েছে, ভোটারদের মাঝেমধ্যে কিছুটা হলেও সংযমী হতে হয়। কারণ, এ পরিণতি তারা নিজেরাই ডেকে এনেছে। যদিও ব্রিটেন কিছুটা স্বাভাবিক হালে রয়েছে কিন্তু বিশ্ববাণিজ্যের এ পরিবর্তনে বেশি দিন তারা থিতু থাকতে পারবে না। ব্রিটিশ সরকারকে অনেকটা সিসিফাসের মতো কঠিন কোনো কাজ করতে হয়েছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের এমনটি নিতে হয়েছে। নাইন ইলেভেন থেকে শুরু করে ব্যাংকিং খাতে ধস, ব্রেক্সিট এবং তারপর করোনা মহামারি দেশটিকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। এখন কিয়ের স্টারমারকে একত্র হয়ে সম্মিলিতভাবে এ সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, সামান্য একটি বিষয় পুঁজি করেই যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে। এমনটি অনেকাংশে বাণিজ্যযুদ্ধও বাধিয়ে দিতে পারে। অনেকে ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতার জন্য অপেক্ষা করার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু ইউরোপ এতদিনে সব দেখেছে। আর দেখার পর এতটুকু নিশ্চিত হয়েছে, কৌশলগুলো ধ্বংসাত্মক। ফলে ইউরোপকে এখন পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েই এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।