দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হতে চলেছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দিতে যাচ্ছে, যা বিদ্যমান লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির বাইরে গিয়ে একটি গণমুখী, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক (inclusive) রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এই উদ্যোগ কেবল একটি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের বার্তা বহন করছে।
রাজনীতি যখন দুর্নীতি, লুটপাট ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক চক্রের দখলে চলে গিয়েছিল, তখন রাজপথে জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি তুলে ধরতে যারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে নাহিদ ইসলাম অন্যতম। তিনি রাজপথে আন্দোলন করে সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছেন, অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। এবার তিনি নতুন রাজনৈতিক শক্তির আহ্বায়ক হিসেবে এগিয়ে আসছেন, যা পরিবর্তনের আশায় থাকা জনগণের জন্য এক আশাব্যঞ্জক বার্তা।
নতুন দলের প্রতিশ্রুতি ও লক্ষ্য
নতুন রাজনৈতিক দলটির মূল লক্ষ্য হবে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও টিক্কা-ভুট্টো চক্রের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করা। এই দল কেবল দেশবিরোধী চক্রান্ত রুখতেই নয়, বরং সমাজের সমস্ত শোষণ, বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবে।
আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি সাধারণত লেজুড়বৃত্তিক ও সুবিধাবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু নতুন দলটি যদি সত্যিই এসব ব্যাধি থেকে মুক্ত থেকে দেশ ও জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, তবে এটি দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে।
গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তিসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতোমধ্যে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে। এই শক্তিগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ থেকে ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সামাজিক সাম্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যায়, তবে নতুন রাজনৈতিক দলটি কেবল একটি সাধারণ রাজনৈতিক সংগঠন থাকবে না, বরং এটি একটি সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করবে।
একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা
দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, গোষ্ঠীবাদ ও ব্যক্তিনির্ভর নেতৃত্ব দেখা গেছে। নতুন দলটি যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে, তবে এটি হতে পারে গণতন্ত্রের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবর্তন।
অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি নিশ্চিত করতে দলটির উচিত সমাজের সকল স্তরের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা—শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক, তরুণ, ছাত্র, পেশাজীবী, নারীবান্ধব নীতি গ্রহণকারী শক্তি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। যদি এটি কেবল একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর রাজনীতির প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়, তবে এটি একটি প্রথাগত রাজনৈতিক দলের মতোই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।
নাহিদ ইসলাম ও তার নেতৃত্বাধীন দল যদি প্রকৃতপক্ষে ন্যায়ের পক্ষে, দুর্নীতি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তবে তারা রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
গণআন্দোলনের ভিত্তিতে গঠিত রাজনৈতিক শক্তি
জুলাই বিপ্লবের সময় গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তিসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে, তা প্রমাণ করে যে ছাত্র ও তরুণ সমাজ এখনও পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি হতে পারে। নতুন রাজনৈতিক দলের উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার উদ্যোগ একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এটি বাস্তবায়িত হলে দলটি আরও গণতান্ত্রিক ও প্রতিনিধিত্বশীল হয়ে উঠবে।
নতুন দলটি সার্বজনীন সরকারের কথা বলছে। কিন্তু সেটি কীভাবে গঠন করা হবে, কীভাবে এর নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হবে, দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় কীভাবে গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করা হবে—এগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি এই কাঠামো একটি স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়, তবে এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে এবং জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে।
ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই
দেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে কিছু সুবিধাবাদী চক্রের দখলে রয়েছে, যারা খুন-ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত থেকেছে। তাদের বিরুদ্ধে নতুন দলটি সোচ্চার থাকবে—এই প্রতিশ্রুতি যদি বাস্তবে পরিণত হয়, তবে এটি সাধারণ জনগণের জন্য এক স্বস্তির বিষয় হবে।
বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা বলে, নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগগুলো প্রায়ই পুরনো ব্যবস্থার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না। ক্ষমতার মোহ, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় স্বার্থের বেড়াজালে আটকে গিয়ে অনেক দলই তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। নতুন দল যদি সত্যিকার অর্থে এই ধরনের ব্যর্থতার ফাঁদে না পড়ে, তবে এটি একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
নাহিদ ইসলামের পদত্যাগ ও নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ
নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। এটি প্রমাণ করে যে তিনি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিকে এগোচ্ছেন এবং বিদ্যমান কাঠামোর সঙ্গে আপস করতে চান না।
তবে প্রশ্ন হলো, নতুন দলটির রাজনৈতিক অবস্থান কী হবে? এটি কি বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ বৈরী সম্পর্ক গড়ে তুলবে, নাকি পরিবর্তনের লক্ষ্যে কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করবে? এ বিষয়টি দলের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ার চ্যালেঞ্জ
একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা যেমন কঠিন, তেমনই তা সফলভাবে পরিচালনা করাও কঠিন। নতুন দলটি যদি সত্যিই লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির বাইরে গিয়ে স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল হতে পারে, তবে এটি দেশের জন্য এক নতুন আশার আলো হয়ে উঠবে।
দলটির উচিত—
গণতান্ত্রিক কাঠামো নিশ্চিত করা: সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া।
নেতৃত্ব বিকেন্দ্রীকরণ করা: কেবল একজন বা কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভর না করে পুরো দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা: অর্থ ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি করা: শ্রমিক, কৃষক, তরুণ, নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
সামনের পথ ও সম্ভাবনা
নাহিদ ইসলাম ও তাঁর সহযোদ্ধাদের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক, তবে সম্ভাবনাও অসীম। তারা যদি সত্যিকার অর্থে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে, তাহলে নতুন রাজনৈতিক দলটি দেশের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারবে।
দেশবাসী এখন অপেক্ষায় আছে—এই নতুন দল কি কেবল স্লোগানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বাস্তবিক পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যাবে? যদি এটি সত্যিই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়, তবে এটি হতে পারে ভবিষ্যতের জন্য এক আশাব্যঞ্জক বার্তা।
নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কেবল ক্ষমতার পালাবদল হবে না, বরং একটি নতুন রাজনৈতিক দর্শন প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করবে। এটি সত্যিকারের পরিবর্তনের সূচনা করতে পারবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক: সাংবাদিক ও সাবেক শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।