বাংলাদেশে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা একটি ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সমাজের জন্য একটি মহামারী রূপ ধারণ করেছে। নারী, শিশু এমনকি পুরুষরাও এই নৃশংস অপরাধের শিকার হচ্ছেন। এই সমস্যা শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ নয়, বরং এটি সমগ্র সমাজের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের উপর একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করেছে। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশে ধর্ষণের বর্তমান পরিস্থিতি, এর কারণ, প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হবে।
ধর্ষণ হল এক ধরনের যৌন সহিংসতা, যেখানে একজন ব্যক্তি অন্যের সম্মতি ছাড়াই জোরপূর্বক যৌন কার্যক্রমে জড়িত হয়। এটি একটি অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন। ধর্ষণ বিভিন্ন রূপে ঘটতে পারে, যেমন: দলবদ্ধ ধর্ষণ, একাধিক ব্যক্তি মিলে একজন ব্যক্তিকে ধর্ষণ করা।
পরিচিতজনের দ্বারা ধর্ষণ, পরিবার, বন্ধু বা পরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণ। বাল্য ধর্ষণ, শিশুদের উপর যৌন সহিংসতা। বিবাহিত জীবনে ধর্ষণ, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর উপর যৌন সহিংসতা।
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বছর হাজার হাজার ধর্ষণের মামলা রেকর্ড করা হয়, তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক লজ্জা, ভয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিরা মামলা করতে এগিয়ে আসেন না।
সরকারি পরিসংখ্যানে, বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ধর্ষণের মামলার সংখ্যা ছিল প্রায় ১,৩০০টি। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর মতে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন প্রায় ১,৬০০ জন নারী ও শিশু।বেসরকারি সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মতে, ২০২২ সালে ধর্ষণের ঘটনা প্রায় ২,০০০টি। এই সংখ্যাগুলো শুধুমাত্র রিপোর্ট করা মামলার, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার পেছনে রয়েছে নানাবিদ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
লিঙ্গ বৈষম্য, বাংলাদেশে নারীদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও নারীকে দুর্বল হিসেবে দেখা। এই লিঙ্গ বৈষম্য ধর্ষণের মতো অপরাধকে উৎসাহিত করে। সমাজে নারীদেরকে পুরুষের অধীনস্থ হিসেবে দেখা হয়, যা তাদেরকে সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে।আইনের দুর্বল প্রয়োগ, ধর্ষণের মামলায় দোষীদের দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া। অনেক ক্ষেত্রে আইনের ফাঁক-ফোকর ও দুর্নীতির কারণে অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যায়। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধর্ষণকে উৎসাহিত করে।
সামাজিক সংস্কৃতি, ধর্ষণকে লজ্জার বিষয় হিসেবে দেখা এবং ভুক্তভোগীদের দোষারোপের মানসিকতা। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদেরকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়, যা তাদেরকে মামলা করতে নিরুৎসাহিত করে।
শিক্ষার অভাব, যৌন শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার অভাব। বাংলাদেশে যৌন শিক্ষা প্রায় অনুপস্থিত, যা নতুন প্রজন্মকে যৌন সহিংসতা সম্পর্কে সচেতন করে না। নৈতিক শিক্ষার অভাবও এই সমস্যাকে বৃদ্ধি করে।অর্থনৈতিক অসঙ্গতি, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অসঙ্গতি ধর্ষণের মতো অপরাধকে উৎসাহিত করে। অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অসঙ্গতির কারণে নারী ও শিশুরা সহিংসতার শিকার হয়।
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে তারা দীর্ঘমেয়াদী ট্রমা, বিষন্নতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাবের শিকার হন। পরিবার ও সমাজের মধ্যে এই ঘটনাগুলো অস্থিরতা ও ভয়ের সৃষ্টি করে।
শারীরিক প্রভাব, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিরা শারীরিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন। এর মধ্যে রয়েছে:শারীরিক আঘাত,যৌন রোগ, গর্ভধারণ
মানসিক প্রভাব, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিরা মানসিকভাবে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন হন। এর মধ্যে রয়েছে:ট্রমা
বিষন্নতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, আত্মহত্যার প্রবণতা
ধর্ষণের ঘটনা সমাজে অস্থিরতা ও ভয়ের সৃষ্টি করে। এর মধ্যে রয়েছে: সামাজিক কলঙ্ক, পরিবারে অস্থিরতা, সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি।
এই সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজন সমন্বিত ও বহুমুখী পদক্ষেপ:
আইনের কঠোর প্রয়োগ
ধর্ষণের মামলায় দ্রুত বিচার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। আইনের ফাঁক-ফোকর বন্ধ করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, ধর্ষণের মামলায় ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা ও সহায়তা প্রদান করতে হবে।
সামাজিক সচেতনতা
নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সম্মান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি। সমাজে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বাড়াতে হবে। ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারাভিযান চালানো প্রয়োজন।
শিক্ষার প্রসার
যৌন শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করা। স্কুল ও কলেজে যৌন শিক্ষা প্রবর্তন করে নতুন প্রজন্মকে যৌন সহিংসতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি করতে হবে।
ভুক্তভোগীদের সহায়তা
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জন্য মানসিক ও আইনি সহায়তা প্রদান। ভুক্তভোগীদের জন্য কাউন্সেলিং ও মানসিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। এছাড়া, আইনি সহায়তা প্রদান করে তাদেরকে ন্যায়বিচার পেতে সাহায্য করতে হবে।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ
সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা রোধ করা। সরকারি নীতিমালা ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব।
বাংলাদেশে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা একটি জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে সরকার, সমাজ ও ব্যক্তি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শুধুমাত্র আইনের কঠোর প্রয়োগ নয়, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে এই মহামারী রোধ করা সম্ভব। আমাদের সকলের উচিত এই অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখা। ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা রোধে আমাদের সকলের সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণই পারে একটি নিরাপদ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে।
লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ।
আমার বার্তা/জেএইচ