রমজান মাস মুমিনের জন্য আনন্দের মাস। ইসলামের মূল পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হলো রমজান মাসে সিয়াম পালন। প্রিয় নবী (সা:) বলেন, ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হলো-এই সাক্ষ্যদান করা যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা মাবুদ নেই আর নিশ্চয় হজরত মুহাম্মদ (সা:) আল্লাহর প্রেরিত রাসুল; সালাত কায়েম বা প্রতিষ্ঠা করা; জাকাত প্রদান করা; হজ করা এবং রমজান মাসে সিয়াম পালন করা। রমজানের উদ্দেশ্য তাকওয়া। তাকওয়া অর্থ আল্লাহর ভয়। আল্লাহর ভয়ে সব মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা। সংযম অবলম্বন করা। এ সংযম সব শ্রেণির মানুষের জন্য। ব্যবসায়ী ও বিক্রেতারা অতি মুনাফার লোভ সংযত করবেন, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি থেকে বিরত থাকবেন। ভোক্তা ও ক্রেতারা অহেতুক অধিক পরিমাণে পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকবেন। সরকার, প্রশাসন শুধু রাজস্ব বাড়ানোর পরিবর্তে জনকল্যাণে ব্রতী হবে। তবেই পবিত্র রমজানের উদ্দেশ্য সফল হবে। রহমতের অফুরন্ত ধারা প্রবাহিত হবে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভ হবে। মাহে রমজানের পবিত্রতা, সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার্থে মুসলমানের অবশ্যই সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মাকে সংশোধন করে আত্মসংযম, শালীনতা ও সদাচরণ প্রদর্শনের অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বারতা নিয়ে প্রতিবছর মুসলিম পরিবারে রমজানের আবির্ভাব ঘটে। ইবাদতের ভরা মৌসুম এই রমজান মাস। মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে এ মাসের প্রভাব ব্যাপক। তাই প্রত্যেক মুসলমানের এ মাসটিকে সার্থকভাবে, যথাযথ মর্যাদায় অতিবাহিত করা একান্ত ইমানি কর্তব্য। কেবল আমল-ইবাদতের মাধ্যমেই নয়; পবিত্র এ মাসের পবিত্রতা রক্ষা করা সবার দায়িত্ব-কর্তব্য। এ জন্য এ মাসে রোজা পালনের পাশাপাশি আরো কিছু আনুষঙ্গিক দায়িত্ব পালন করা জরুরি।
সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে পবিত্র রমজান মাসের পবিত্রতা বজায় রাখা এবং এ মাসটিকে যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করা সম্ভব। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, সম্ভবত তোমরা খোদাভীরু হতে পারবে। রমজান হচ্ছে মুমিনদের তাকওয়াবান তথা মুত্তাকী হিসেবে তৈরি করার মাস। এ মাসে মুমিন মুসলমানগণ সারাদিন পানাহার ও স্ত্রী সান্নিধ্য থেকে বিরত থেকে ক্ষুৎপিপাসা বরণ করে নিজেকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে তৈরি করে। পবিত্র রমজান মাসে মুমিনদের মধ্যে আল্লাহর নির্দেশ পালন করার জন্য অভ্যাস তৈরি হয়।রমজান হচ্ছে মুসলমানদের প্রশিক্ষণের মাস। যে মাসে একজন মুসলিম আল্লাহর নির্দেশ পালন এবং নিষেধ থেকে বিরত থাকার বাস্তব প্রশিক্ষণ লাভ করে। যে প্রশিক্ষণের আলোকে বাকি ১১টি মাসে পরিচালিত হবে। নিজের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ সমূহ পালন করবে আল্লাহর নিষেধ সমূহ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে-এটাই হচ্ছে রমজানের মূল শিক্ষা। একজন রোজাদার পানাহার বর্জনের মাধ্যমে সেই শিক্ষায়ই শিক্ষিত হয়ে থাকে। আমরা আশা করব রমজানের এই শিক্ষাকে বাংলাদেশের সকল মুসলমানরা সঠিকভাবে গ্রহণ করবে। তারা রোজা পালনের ন্যায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ সমূহ পালন করবে এবং নিষেধ সমূহ থেকে বিরত থাকবে। আর সে জন্য প্রথমত প্রয়োজন হচ্ছে রমজানের মাসকে পবিত্র মাস হিসেবে সম্মান করা। রমজানের সুযোগে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করা। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, মানুষকে জিম্মি করে আয়-উপার্জন না করা। রমজানের শিক্ষা হচ্ছে অশ্লীলতা বেহায়াপনা থেকে দূরে থাকা।
রমজানের শিক্ষা হচ্ছে মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করা। পরের হক না খাওয়া। সমাজের বঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। দুস্থদের সেবা করা। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে দরিদ্র থাকলে তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা। রমজানের শিক্ষা হচ্ছে বেশি বেশি দিনের বেলা অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ কোরআন তেলাওয়াত করা, এবং কোরআনের মর্মবাণী উপলব্ধি করা। রাতের গভীরে আল্লাহর এবাদত করা। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করা, তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রহমতের জন্য দোয়া করা। বর্তমান বিশ্বে যাতে আল্লাহ শান্তি মানবজাতির জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করেন, গজব থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করেন বিশেষ করে মুসলমানদেরকে সকল প্রকার বিপ-আপদ থেকে হেফাজত করেন, সেজন্য রোজাদাররা প্রতিদিন আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। পবিত্র মাহে রমজানে আমরা সবাই রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করবো। পাশাপাশি আমাদের নিজেদের জন্য এবং দেশের জন্য আল্লাহর রহমত বরকত লাভের জন্য দোয়া করবো। আল্লাহ যেন এই রমজানের উসিলায় আমাদের গুনাহ মাফ করেন এবং আমাদের সবাইকে সকল রকম বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করেন। এটাই হোক সবার প্রত্যাশা। আমরা রমজানের পবিত্রতা বলতে শুধু বুঝে থাকি, রমজানে হোটেল বন্ধ থাকা বা তার সামনে পর্দা ঝুলিয়ে দেওয়া। আসলে শুধু এটিই রমজানের পবিত্রতা রক্ষা নয়; বরং খাবার হোটেল তো মুসাফির ও অসুস্থ ব্যক্তির জন্য খোলা রাখা অনেক ক্ষেত্রে জরুরিও বটে। আসলে রমজানের পবিত্রতা হলো, রোজাদার আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ওই সব কাজ পরিত্যাগ করা, যা তার জন্য অন্য মাসগুলোতে হালাল ছিল এবং রমজানেও হালাল। এসব কাজ এ জন্য পরিত্যাগ করা যে আল্লাহ তাআলা রোজা অবস্থায় এই কাজগুলো থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
বিশেষত ঈদকে কেন্দ্র করে রমজানে যে অবস্থা আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত হয়, তা খুবই বেদনাদায়ক। অনেকে কেনাকাটার পরিবর্তে মার্কেটগুলোর পরিদর্শনে মগ্ন, না আছে ফরজ নামাজের জামাতে উপস্থিতি, না তারাবির গুরুত্ব। তিলাওয়াত, তাসবিহ, দোয়া ও রোনাজারিও পরিত্যাজ্য। এরপর নগ্নতা ও নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণসহ অন্য হারাম কাজগুলো তো রয়েছেই, যেগুলো আল্লাহর অভিশাপ ডেকে আনে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য ও কেনাকাটায় এত মগ্ন হওয়া উচিত নয় যে নামাজের জামাত ও তারাবি ছুটে যায়। আর ব্যবসায় ধোঁকাবাজি, অহেতুক মূল্য বৃদ্ধি ও প্রতারণা এবং সুদ ও জুয়াসহ অন্য সব হারাম কার্যকলাপ থেকে সারা বছরই বেঁচে থাকা ফরজ, রমজান মাসে এর অপরিহার্যতা আরো বেড়ে যায়। কেননা বরকতপূর্ণ সময়ের গুনাহও আরো সর্বগ্রাসী হয়ে থাকে।আল্লাহ তায়ালা মাহে রমজানে হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রজনী ‘লাইলাতুল কদর’ দান করে এ মাসকে আরো মহিমান্বিত করেছেন এবং তিনি পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, কদরের রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি কদরের রজনীতে ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের আশায় ইবাদতের জন্য দন্ডায়মান হয়, তার পিছনের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (বুখারী, মুসলিম) এ মাসে দয়াময় আল্লাহর রহমতের সাগরে জোয়ার আসে। তাঁর অফুরন্ত নেয়ামতরাজি বৃষ্টির ন্যায় অবিরাম বর্ষিত হয়। ক্ষমার দরজা সকলের জন্য অবারিত করা হয় এবং অভিশপ্ত শয়তানকে শৃংখলিত করা হয়। আর মাসজুড়ে মুমিনদের মাঝে শুরু হয় স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের এক মহা আয়োজন। দয়াময় প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এই সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এ মাসে নিজের ভুলত্রুটি ও গুনাহসমূহ ক্ষমা করাতে পারলো না, তার চেয়ে হতভাগা এ জগতে আর কেউ নেই।
তাই আসুন! গুনাহমুক্ত জীবন গঠন ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের প্রত্যয়ে পবিত্র মাহে রমজানকে পালন করুন। মাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করুন। খাদ্যে ভেজাল, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, প্রতারণা, মুনাফাখোরি ও মজুতদারিসহ সকল অপরাধকে না বলুন। জুলুম, মিথ্যা, গীবত, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, হিংসা, অহঙ্কারসহ সকল প্রকার অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। ইসলাম, সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকুন। সমাজের উপেক্ষিত, অসচ্ছল ও অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়ান। বিশেষ করে মাহে রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত মহান মালিকের সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের প্রয়াসে ব্যয় করুন। মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফিক দান করুন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।
আমার বার্তা/রায়হান আহমেদ তপাদার/এমই