
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান উদ্বেগ ‘অদৃশ্য শক্তির’ প্রভাব। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলো বলেছে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে ভোটের মাঠে এ ধরনের প্রভাব ও চাপ সম্পূর্ণভাবে ঠেকাতে হবে। আর সে দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি ইসিরই—তাদের হতে হবে দৃঢ়, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ।
রোববার (১৬ নভেম্বর) আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে দ্বিতীয় দিনের প্রথম পর্বের সংলাপে অংশ নিয়ে দলগুলোর প্রতিনিধিরা বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, প্রশাসন, প্রভাবশালী গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অঘোষিত প্রভাবই ভোটের পরিবেশকে সবচেয়ে বেশি নষ্ট করে। এবার সেই সুযোগ যেন কেউ না পায়, সে জন্য ইসিকে শুরু থেকেই কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
অর্ধশতাধিক নিবন্ধিত দলের মধ্যে বৃহস্পতি ও রোববার দুই দিনে ২৪টি দলের সংলাপ হলো।
গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী অতীতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘অনেক আশা-ভরসা ছিল, ইসির ওপর সারা জাতির আস্থা থাকে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, অতীতে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষ ছিলেন হয়ত, তাদের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা পাইনি। তাদের সাথে অদৃশ্য শক্তি ছিল।’
সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচনটাকে কলুষিত করার ব্যবস্থা ছিল। ৫৪ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে লাভ নেই। তবে দুয়েকটা নির্বাচন হয়ত ভালো হয়েছে। আপনাদের মেয়াদে সংসদ হোক, স্থানীয় নির্বাচনে নিরপেক্ষতা যেন ধরে রাখেন। সেটা যেন জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়। এখনো আপনাদের প্রতি আশ্বস্ত আছি।…ফেব্রুয়ারিতে একটা নির্বাচন হবে, গণভোটও হবে।’
গণভোটের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “বিদ্যমান প্যাকেজে হাঁ, না ভোট হলে এটা অকার্যকর হয়ে যাবে। দুটোতে হ্যাঁ, দুটোতে না এর সুযোগ নেই। সবটার মধ্যে হ্যাঁ অথবা না-তে নিয়ে যাচ্ছে। দল, সরকার ও ইসির ভূমিকা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত গণভোট যেন হাস্যকরে পরিণত না হয় আপনাদের হাত দিয়ে। এ ব্যাপারে আপনাদের শক্ত থাকতে হবে।’
গণফ্রন্টের মহাসচিব আহমদ আলী শেখ বলেন, ‘আজ অবধি ইসি অবিচারের শিকার হয়েছে। অবিচারগ্রস্ত ইসির অধীনে আমরা যারা নির্বাচন কমিশন তাদের অবস্থা নিঃসন্দেহে শোচনীয়।’
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ এন এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, আগামী নির্বাচন ভালো করার জন্য ইসির আন্তরিকতা রয়েছে। নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে বিভাগওয়ারি ভোট নেওয়া, জামানত কমানো, ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা রাখার সুপারিশ করেন তিনি।
জোট করলেও স্ব স্ব দলের প্রতীকে ভোট করার বিধান চালু করায় মহাসচিব জাফর আহমেদ জয় ইসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘শঙ্কিত যে, জারি করা বিধিমালা রাখতে পারবেন কি না। আশা করি, অতীতের শিক্ষা থেকে কারো কাছে নতজানু হবেন না। শপথ নিয়েছেন। আপনাদের ঘাড়ে জাতির দায়িত্ব, কারো চাপে দায়িত্ব পালন যদি না করতে পারেন তাহলে উত্তম পথ আছে, সে পথ নেবেন। কিন্তু নতজানু হবেন না।’
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী ৯টি প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলেন, ‘গত ১৫ বছরে যে তিনটি নির্বাচন হয়, সবটিই বিতর্কিত। ভোট নিয়ে আস্থা সংকট তৈরি হয়। গোট নির্বাচন ব্যবস্থা সঙ্কটাপন্ন।’ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত, সারাদেশে একই দিনে নির্বাচন না করে চার ধাপে আয়োজন করার দাবি জানান তিনি।
প্রথমবারের মতো একদিনে দুই ভোট, বাড়তি প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি
বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির প্রতিনিধি সংলাপে অংশ নিয়ে কালো টাকা রোধে ইসির দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
শুরুতে ইসির সংলাপে হাজির হয় ইসলামী ঐক্যজোটের দুই পক্ষ। এরপর হট্টগোল শুরু হলে যাদের কাছে চিঠি নেই তাদের সম্মেলন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বলেন ইসি সচিব।
সম্মেলন কক্ষ থেকে বের হওয়া অংশ থেকে মইনুদ্দিন রুহি সাংবাদিকদের বলেন, তাদের চিঠি ব্ল্যাকমেল করে আরেক অংশ সংলাপে অংশ নিয়েছে।
ইসলামী ঐক্যজোটের এক পক্ষ সম্মেলন কক্ষ ত্যাগ করলে ইসি সচিব বলেন, ‘আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত অসামঞ্জস্যতা দিয়ে শুরু করার জন্য।’
পরে ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসেন রাজী সংলাপে তার বক্তব্যে বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে এই ফ্যাসিবাদের দোসররা কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখল করে নিয়ে স্বার্থ হাসিল করেছে। ৫ আগস্টের পর থেকে তারা আত্মগোপনে ছিল। এরপর আমরা দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের নিয়ে দল নতুন করে পুনর্গঠন করা হয়েছে।’
‘যারা পেশীশক্তি দেখাবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’
আসন্ন নির্বাচনে যারা পেশীশক্তি দেখাবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বার্তা দেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, ‘যারা পেশীশক্তি দেখাবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে-এটাই ইসির বার্তা। এ ব্যাপারে কোনো ব্যত্যয় হবে না। অপপ্রচার ছড়ালে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কর্মকর্তারা পক্ষপাতদুষ্ট হলে সে বা তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ তিনটি বার্তা ইসির।’
এ নির্বাচন কমিশনার জানান, বিগত দিনগুলোই নির্বাচনি সংস্কৃতিতে নানা ধরনের দুর্বলতা ছিল। উৎসবের আমেজেই ছিল। কিন্তু ওভার এপিরিয়ড অব টাইম এ সংস্কৃতিটাই নষ্ট হয়ে গেছে। দুঃখজনজন হলেও মানুষ নির্বাচনবিমুখ হয়েছে, নির্বাচনের নামে বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম হয়েছে।
সানাউল্লাহ বলেন, ‘অতীতের জোরপূর্বক কেন্দ্র দখল, সিল মারা কিংবা প্রকাশ্যে নির্দিষ্ট দল ছাড়া কাউকে নির্বাচনে না আসার বার্তা—এসব রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হলে সবাইকে মিলে ভালো সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে। এর জন্য সহাবস্থান, সহনশীলতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা জরুরি।’
আত্মসমালোচনার জায়গা থেকে তিনি স্বীকার করেন, ‘ইসির ভুলের শেষ নেই। তবে আশ্বস্ত করছি—সেসব ভুল যাতে আর না ঘটে, সে লক্ষ্যেই কাজ করছি।’
১৮ নভেম্বর পোস্টাল ভোট বিডি অ্যাপ উদ্বোধনের কথা তুলে ধরে আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘এ প্রক্রিয়া বৈশ্বিকভাবে কঠিন। ভারতের চার কোটি প্রবাসীর মধ্যে যেখানে মাত্র এক লাখ ১৯ হাজার নিবন্ধন হয়েছিল, মালয়েশিয়ায় ১৮ লাখের মধ্যে নিবন্ধিত হয়েছিল ৫৫ হাজার। আমরা আশা করছি—সমমানের দেশের তুলনায় এগিয়ে থাকতে পারব। দলগুলোকেও প্রচারণায় ভূমিকা রাখতে হবে। ভোটের গোপনীয়তা ও নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে হবে।’
তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘গোপনীয়তা ভঙ্গ করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রবাস ভোট নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে স্থানীয় নির্বাচনও প্রভাবিত হবে।’
মিসইনফরমেশন রোধে সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, ‘তফসিলের পর ইসি দায়িত্ব নিলেও ব্যান্ডউইথ বা ওয়েবসাইট বন্ধ করে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ভালো তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করা, অপতথ্য রোধ করা—এতে সবার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থারও দায়িত্ব আছে।’
দল ও কর্মীদের প্রতি সতর্ক বার্তা দিয়ে তিনি বলেন, ‘অপতথ্য ছড়ালে দায় এড়ানো যাবে না। আচরণবিধি ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সানাউল্লাহ বলেন, ‘জাতির ক্রান্তিলগ্নে ইসির যা করণীয় আমরা করব। তবে আপনাদের সহযোগিতা পেলে সামান্য প্রস্তুতি দিয়েই ভালো নির্বাচন সম্ভব।’
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘আমরা নতজানু হবো না। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা করার দরকার করছি, ভালো নির্বাচন করার বিকল্প রাস্তা নেই। আপনাদের সহযোগিতা চাই। পোলিং এজেন্ট নিয়োগের বিষয়ে দলগুলো যেন আগে থেকেই এক্সারসাইজ করে ভালো হবে।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আশা করি, দলগুলোর প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাবো। এটা জাতীয় বিষয় সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়া। জাতি হিসেবে আমরা একসাথে কাজ করে কামিয়াব হবো।’
তিনি জানান, কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে সেখানেই শুধু ‘না’ ভোট হবে। নির্বাচিত হওয়ার পর হলফনামায় গোজামিল থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
আমার বার্তা/এমই

