রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, একদিন হজরত মূসা (আ.) বনী ইসরাঈলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন, বর্তমান সময়ে আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী কেউ আছে কী? ওই সময়ে যেহেতু মূসা ছিলেন শ্রেষ্ঠ নবী এবং তাঁর জানা মতে আর কেউ তাঁর থেকে অধিক জ্ঞানী ছিলেন না, তাই তিনি সরলভাবে ‘না’ সূচক জবাব দেন। জবাবটি আল্লাহর পছন্দ হয়নি। কেননা এতে কিছুটা অহংকার প্রকাশ পেয়েছিল। ফলে আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষায় ফেললেন। তাঁর উচিৎ ছিল একথা বলা যে, ‘আল্লাহই সর্বাধিক অবগত’।
আল্লাহ তাঁকে বললেন, ‘হে মূসা! দুই সমুদ্রের সংযোগস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আছে, যে তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী’। একথা শুনে মূসা (আ.) প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে ঠিকানা বলে দিন, যাতে আমি সেখানে গিয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারি’।
আল্লাহ বললেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নাও এবং দুই সমুদ্রের (সম্ভবত, লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের মিলনস্থল) দিকে সফরে বেরিয়ে পড়। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি জীবিত হয়ে বেরিয়ে যাবে, সেখানেই আমার সেই বান্দার সাক্ষাৎ পাবে।
মূসা (আ.) নিজের ভাগিনা ও শিষ্য (এবং পরবর্তীকালে নবী) ইউশা বিন নূনকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে এক স্থানে সাগরতীরে পাথরের উপর মাথা রেখে দু’জন ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ সাগরের ঢেউয়ের ছিটা মাছের গায়ে লাগে এবং মাছটি থলের মধ্যে জীবিত হয়ে নড়েচড়ে ওঠে ও থলে থেকে বেরিয়ে সাগরে গিয়ে পড়ে।
ইউশা ঘুম থেকে উঠে এই বিস্ময়কর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু মূসা (আ.) ঘুম থেকে উঠলে তাঁকে এই ঘটনা বলতে ভুলে গেলেন। তারা আবার পথ চলতে শুরু করলেন এবং একদিন একরাত চলার পর ক্লান্ত হয়ে এক স্থানে বিশ্রামের জন্য বসলেন।
মূসা (আ.) নাশতা দিতে বললেন। তখন তার মাছের কথা মনে পড়ল এবং ভুলে যাওয়ার অজুহাতের কথা জানিয়ে সব ঘটনা মূসা (আ.)-কে বললেন এবং বললেন যে, ‘শয়তানই আমাকে একথা ভুলিয়ে দিয়েছিল’। মূসা (আ.) বললেন, ওই স্থানটিই তো আমাদের গন্তব্য ছিল।
তারা আবারো সে পথে ফিরে গিয়ে দেখতে পেলেন, একজন লোক আপাদ-মস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। মূসা (আ.) তাকে সালাম করলেন। লোকটি মুখ বের করে বললেন, এদেশে সালাম? কে আপনি? বললেন, আমি বনী ইসরাঈলের মূসা। আপনার কাছ থেকে ওই জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ আপনাকে বিশেষভাবে দান করেছেন।
খিজির আ. বললেন, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না ! আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তা তিনি আপনাকে দেননি। পক্ষান্তরে আপনাকে তিনি যে জ্ঞান দান করেছেন, তা আমাকে দেননি’।
মূসা আ. বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আমি আপনার কোন আদেশ অমান্য করব না।
খিজির বললেন, ‘যদি আপনি আমার অনুসরণ করেনই, তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজে সে সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলি।
এরপর তারা হাঁটতে শুরু করলেন। কিছু দূর গিয়ে নদী পার হওয়ার জন্য একটা নৌকা পেলেন। নৌকা থেকে নামার সময় এতে ছিদ্র করে দিলেন।
কোনো কারণ ছাড়াই অন্যের নৌকা ছিদ্র করে দেওয়া স্পষ্টভাবেই অন্যায়। তাই নবী মূসা আ. বিষয়টিকে মেনে নিতে পারলেন না। তিনি বলেই ফেললেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি একটা গুরুতর মন্দ কাজ করলেন’।
তখন খিজির আ. বললেন, আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’।
মূসা আ. ক্ষমা চাইলেন। ইতিমধ্যে একটা কালো চড়ুই পাখি এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক চঞ্চু পানি তুলে নিল। সে দিকে ইঙ্গিত করে খিজির আ. মূসা (আ.)-কে বললেন—
আমার ও আপনার এবং সমস্ত সৃষ্টিজগতের জ্ঞান মিলিতভাবে আল্লাহর জ্ঞানের মুকাবিলায় সমুদ্রের বুক থেকে পাখির চঞ্চুতে উঠানো এক ফোঁটা পানির সমতুল্য।
সমুদ্রের তীর ঘেঁষে চলতে চলতে তারা দেখলেন, সাগরতীরে একদল শিশু খেলাধুলা করছে। খিজির আ. তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও বুদ্ধিমান ছেলেটিকে ধরে এনে নিজ হাতে হত্যা করলেন। এ দৃশ্য দেখে মূসা আৎকে উঠে বললেন, একি! একটা নিষ্পাপ শিশুকে আপনি হত্যা করলেন?
খিজির আ. বললেন, আমি তো আগে বলেছিলাম, আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’। মূসা আবার ক্ষমা চেয়ে বললেন, ‘এরপর যদি আমি কোন প্রশ্ন করি, তাহলে আপনি আমাকে আর সাথে রাখবেন না’।
এবার তারা হাঁটতে হাঁটতে একটি জনপদে পৌঁছলেন, তাদের কাছে খাবার চাইলেন। কিন্তু তারা তাদের আতিথেয়তা করতে অস্বীকার করল। অতঃপর তারা সেখানে একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেয়ে সেটাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন।
তখন মূসা আ. বললেন, আপনি ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিতে পারতেন’। খিজির আ. বললেন, এখানেই আমার ও আপনার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হলো। এখন যেসব বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারেননি, আমি সেগুলির তাৎপর্য বলে দিচ্ছি।
নৌকা ছিদ্র করে দেওয়ার কারণ
নৌকাটিছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি ইচ্ছা করলাম যে, সেটিকে ত্রুটিযুক্ত (নষ্ট) করে দেই। (কেননা) তাদের অপরদিকে ছিল এক বাদশাহ। সে বলপ্রয়োগে প্রত্যেকটি (ভালো) নৌকা ছিনিয়ে নিত।’ (সূরা কাহাফ: ৭৯)
ছোট বাচ্চাকে মেরে ফেলার কারণ
কিশোরটির পিতামাতা ছিল মুমিন। সে বড় হওয়ার পর সীমালঙ্ঘন ও কুফরির মাধ্যমে তাদেরকে অতিষ্ঠ করে তুলবে। তাই তাকে হত্যা করা হয়েছে, যেন তাদের রব তাদেরকে তার পরিবর্তে এমন এক সন্তান দান করেন, যে হবে পবিত্রতায় উত্তম ও দয়া-মায়ায় ঘনিষ্ঠতর। (সূরা কাহাফ: ৮০-৮১)
প্রাচীর সোজা করে দেওয়ার কারণ
প্রাচীরটি ছিল নগরের দুজন পিতৃহীন বালকের। এর নিচে ছিল তাদের (বাবার রেখে যাওয়া) গুপ্তধন এবং তাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। তারা বড় হওয়ার পর যেন এই গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারে তাই দেওয়ালটি ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। (সূরা কাহাফ: ৮২)
আমার বার্তা/এল/এমই