
উত্তর ইসরায়েলের গালিলি সাগরের তীরবর্তী একটি প্রাগৈতিহাসিক গ্রাম থেকে প্রায় ১২ হাজার বছর পুরোনো একটি মাটির মূর্তি উদ্ধার করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। বিশ্বজুড়ে আবিষ্কৃত পৌরাণিক দৃশ্যের অন্যতম প্রাচীন চিত্রায়ণ হতে পারে এটি। এই মূর্তিটিতে বসা অবস্থার একজন নারী এবং একটি রাজহাঁসকে বিশেষ ভঙ্গিতে চিত্রিত করা হয়েছে।
‘নাহাল এইন গেভ টু’ নামক স্থানে ৫ মিটার ব্যাসের অর্ধবৃত্তাকার পাথরের কাঠামোর ভেতরে মূর্তিটি পাওয়া যায়। মাত্র দেড় ইঞ্চি উচ্চতার এই ক্ষুদ্রাকৃতির শিল্পকর্মটি দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার নাতুফিয়ান সংস্কৃতির অংশ। এই সংস্কৃতিটি ছিল সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের, যখন শিকারি-সংগ্রাহক যাযাবর সম্প্রদায়গুলো ধীরে ধীরে কৃষিনির্ভর স্থায়ী সমাজে রূপান্তরিত হচ্ছিল।
হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব গবেষক ও এই গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক লরেন্ট ডেভিন জানিয়েছেন, এটিই সম্ভবত বিশ্বে এ যাবৎ আবিষ্কৃত প্রাচীনতম মূর্তি, যেখানে মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে মিথস্ক্রিয়া দেখানো হয়েছে। একই সঙ্গে, এটি দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার শিল্পকর্মে নারীর প্রাচীনতম স্বাভাবিক এবং শৈলীবিহীন চিত্রায়ণ বলেও তিনি উল্লেখ করেন। গবেষণাটি প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
মূর্তিটিতে রাজহাঁসটিকে এমনভাবে নারীর পিঠের ওপর রাখা হয়েছে, যা হাঁসের স্বাভাবিক মিলনকালীন ভঙ্গিমার নির্দেশ করে। গবেষকদের মতে, এই দৃশ্যটি প্রাগৈতিহাসিক এই সমাজের বিশ্বাস ব্যবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ একটি অন্তর্দৃষ্টি দেয়।
গবেষণার সহ-লেখক, হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ লিওরি গ্রসম্যান এই মিথস্ক্রিয়াকে ‘একটি প্রাণী আত্মার সঙ্গে মানুষের কল্পিত মিলনের চিত্রায়ণ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘স্বপ্ন, শামানিক দর্শন বা পৌরাণিক কাহিনির মতো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সর্বপ্রাণবাদী সমাজগুলোতে এই থিমটি খুবই সাধারণ।’
কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ নাটালি মুনরো বলেন, ‘মানুষ ও পশুর মধ্যে যৌনতা-সম্পর্কিত মিথস্ক্রিয়া চিত্রিত করার এই দৃশ্যটি পৌরাণিক কাহিনির দীর্ঘ ঐতিহ্যের অংশ। এই ধরনের চিত্রণ খুব কমই আক্ষরিক অর্থ বহন করে। এর পরিবর্তে, এটি প্রায়শই নারীর উর্বরতা, আধ্যাত্মিক বিশ্বাস বা জীবনের পবিত্রতা প্রতীকী অর্থে প্রকাশ করে।’
প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বলছেন, মূর্তিটি কাদামাটি দিয়ে তৈরি করার পর শুকিয়ে এরপর টেকসই করার জন্য পোড়ানো হয়েছিল। পরে এতে লাল রঞ্জক পদার্থ দিয়ে রং করা হয়। গবেষকেরা মূর্তিটিতে এর নির্মাতার আঙুলের ছাপও খুঁজে পেয়েছেন।
ডেভিন ব্যাখ্যা করেন, ভাস্কর এই মূর্তির বাম অংশের ওপর জোর দিয়ে আলো ও ছায়ার ব্যবহার করে গভীরতা ও বিশেষ দৃষ্টিকোণ তৈরি করেছেন। এটি সেই সময়ের জন্য এক নতুন শৈল্পিক উদ্ভাবন ছিল, যা অনেক পরে পূর্ণতা পায়। এই কৌশল থেকে অনুমান করা যায়, মূর্তিটি সম্ভবত এমন একটি স্থানে স্থাপন করা হয়েছিল যেখানে সূর্য বা আগুনের আলো পড়লে নারী ও রাজহাঁসের মধ্যে মিথস্ক্রিয়াটি জীবন্ত হয়ে উঠত।
এই ধরনের মূর্তিগুলো অলংকার, সুরক্ষামূলক মাদুলি বা গল্প বলার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, এই বিশেষ মূর্তিটি সম্ভবত একটি মঞ্চ প্রদর্শনীর অংশ ছিল, যা গ্রামের অধিবাসীরা দল বেঁধে দেখতে আসত। মূর্তির সঙ্গে একই স্থানে মানুষের দাঁত এবং একটি শিশুর দেহাবশেষও পাওয়া গেছে, যা স্থানটির ধর্মীয় বা আচারগত তাৎপর্য নির্দেশ করে।
গবেষকেরা বলেন, এই আবিষ্কার প্রমাণ করে, স্থায়ী জীবনযাপন কীভাবে সামাজিক কাঠামো এবং ফলস্বরূপ গল্প বলা, প্রতীকী অভিব্যক্তি এবং শৈল্পিক কৌশলগুলোর রূপান্তরে সহায়তা করেছিল।
আমার বার্তা/এমই

